পরিত্যক্ত সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রকে ভূগর্ভস্থ এলএনজি মজুদাগারে রূপান্তরের কথা ভাবছে সরকার
স্থিতিশীল গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) মজুদ রাখতে সরকার বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত পরিত্যক্ত সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রকে ভূগর্ভস্থ সংরক্ষণাগার হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রানুসারে, দেশের বাইরে থেকে স্বল্পমূল্যে এলএনজি আমদানি করে মজুদ রাখার পরিকল্পনা করছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম ও চাহিদা বাড়লে এই মজুদকৃত গ্যাস ব্যবহৃত হবে।
গ্যাসক্ষেত্রটি ভূগর্ভস্থ গ্যাস মজুদাগার হিসেবে ব্যবহারের উপযুক্ত কি না, তা জানতে সম্ভাব্যতা জরিপ পরিচালিত হবে। জরিপ পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে আমেরিকান বহুজাতিক করপোরেশন এক্সনমবিল-এর সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান, উৎপাদন, পরিবহন ও বিক্রির দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা ।
পরিকল্পনায় সরাসরি যুক্ত পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গ্যাসক্ষেত্রটিতে কী পরিমাণ এলএনজি মজুদ রাখা সম্ভব এবং মজুদকৃত গ্যাসের সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদনের সম্ভাব্য খরচ জরিপ শেষে জানা যাবে।
তিনি জানান, সাঙ্গুর প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরিচালিত একটি 'ডেস্কটপ স্টাডি' অনুসারে এক্সনমবিলের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। জরিপ অনুসারে, সাঙ্গুতে ভূগর্ভস্থ মজুদাগার স্থাপন করা সম্ভব বলে দাবি করেছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি।
ডেস্কটপ জরিপে মূলত কোনো ঘটনাস্থলে অনুসন্ধানের পূর্বে সেখানকার বিভিন্ন তথ্যচিত্রের সমন্বয়ে ডেস্কে বসেই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এ ধরনের পরিষেবা দানকারী ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ওয়েসন এনভায়রনমেন্টালের মতে, প্রকল্পের রূপরেখা তৈরির জন্য ঘটনাস্থলের ইতিহাস, ভূতত্ত্ব, হাইড্রোজোলজি, হাইড্রোলজি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দূষণ ইত্যাদি পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, এক্সনমবিলের একটি প্রস্তাবনার ভিত্তিতে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা জরিপ পরিচালনার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
তিনি বলেন, "বিষয়টি এখনও একদম প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। প্রযুক্তিগত ও আর্থিক দিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হলে আমরা পরবর্তী ধাপে আগাব।"
তবে, মজুদকৃত গ্যাস উত্তোলন ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এই প্রকল্প সঙ্গতিপূর্ণ হবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
বুয়েটের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এম তামিম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ মজুদাগার স্থাপনের বহু উদাহরণ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি বিষয়ক তথ্য প্রশাসনের মতে, বর্তমানে সেখানকার ৪৮টি অঙ্গরাজ্যে ৩৮৭টি গ্যাস মজুদাগার চালু রয়েছে।
"তবে, এ ধরনের মজুদাগার কৌশলগত দিক থেকে কার্যকরী হতে হবে, যেন কোনো লিকেজ বা ছিদ্রপথ না থাকে। অন্যথায় এ ধরনের মজুদাগার কোনো উপকারে আসবে না," বলেন তিনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। অন্যদিকে, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়।
শিল্পকারখানা ও বিদ্যুৎ খাতের বাড়তে থাকা চাহিদা পূরণে সরকার ২০১৮ সালে এলএনজি আমদানি শুরু করে। কক্সবাজারের মহেশখালীর কাছে সমুদ্রে ভাসমান মজুদাগার এবং রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে তা জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
দুটি ইউনিটে দিনে প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা থাকলেও এখন পর্যন্ত দিনে কেবল ৬০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হয়েছে।
বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বাড়তে থাকায় দেশে গ্যাসের হাহাকার সত্ত্বেও সরকার মজুদে থাকা এই রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের পূর্ণ ব্যবহার থেকে বিরত থেকে এলএনজি আমদানি করছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম নিয়ে অস্থিরতা পর্যবেক্ষণ করার পর সরকার এখন সাশ্রয়ী মূল্যে জাতীয় গ্রিডে স্থিতিশীল গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে মজুদাগার স্থাপনের চেষ্টা করছে।
এর আগে পেট্রোবাংলা মহেশখালীতে স্থলভাগে এলএনজি মজুদাগার স্থাপনের পরিকল্পনা অনুযায়ী জাপানের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা জরিপ শুরু করে।
বর্তমানে, ২০১৩ সাল থেকে পরিত্যক্ত সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রকেও এলএনজি মজুদাগার হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে সরকার।
আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি অপেক্ষাকৃত স্বল্পদামে পাওয়া গেলে আমদানি করে সমুদ্রের নিচে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে মজুদ রাখা হবে। বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেলে মজুদকৃত গ্যাস উত্তোলন করা হবে।
১৯৯৬ সালে ব্রিটিশ তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান কেয়ার্ন এনার্জি সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পায়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সাঙ্গুতে গ্যাস উত্তোলন চলে। হিসাব অনুসারে গ্যাসক্ষেত্রটিতে ৫৭৭.৭৮ বিলিয়ন ঘনফুট (বিএসএফ) গ্যাস মজুদ ছিল।
২০১৩ সালের অক্টোবরে পরিত্যক্ত ঘোষণার আগে ৪৮৭.৯১ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়। তখন থেকেই গ্যাসক্ষেত্রটি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাধীন।
দীর্ঘদিন ধরে সাঙ্গুর রক্ষনাবেক্ষণের কাজ বন্ধ আছে। ভূমি থেকে সাঙ্গুর নজরদারিতে স্থাপিত ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরাগুলোও কাজ করে না। সর্বশেষ সৌরবিদ্যুৎ-চালিত বাতি স্থাপনের সময় গ্যাসক্ষেত্রটিতে কাজ করা হয়।
জাহাজের নিরাপদ চলাচলের জন্য সম্প্রতি পেট্রোবাংলা বিকন লাইট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।