পরিবেশকে পর্যুদস্ত করে ব্যবসা, তেল তৈরিতে পোড়ানো হচ্ছে টায়ার, টিউব
'টায়ার-টিউব আর কনডমের পোড়া কালির জন্য প্লেটে ভাত খাওয়া যায় না। কাপড়-চোপড় কালির আস্তরণে একাকার। কারখানার পোড়া তেলে কৃষি জমি সয়লাব। গাছের ফলগুলো অকালেই ঝড়ে যায়। প্রতিবাদ করলে তার কপালে শনি দেখা দেয়। মামলা দিয়ে প্রতিবাদকারীকেই জিম্মি করা হয়', এভাবে কথাগুলো বলেছেন বগুড়ার কাহালু উপজেলা দেওগ্রাম এলাকার বাসিন্দা আঞ্জুরায়া বেগম। তার বাড়ি থেকে টায়ার-টিউব পোড়ানা আফরোজা বার্নিং ওয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের দূরত্ব ৫০ ফিটের মতো হবে। এই কারখানার উৎকট গন্ধের ধোঁয়ায় নাকাল এলাকার মানুষ।
কারখানাটির শুরু থেকেই পরিবেশ আইন অমান্য চালু রয়েছে। আট বছর আগে গড়ে ওঠা এই কারখানার বিরোধিতা করেছিলেন এলাকাবাসী। তার ফলও ভালো হয়নি। উল্টো কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজির মামলা দিয়েছে।
তবে ওই কারখানার ম্যানেজারের দরজার সামনে জেলা প্রশাসকের একটি নথি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৯ মে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ফারজানা ফেরদৌস জামান স্বাক্ষরিত ওই নথিতে বলা হয়েছে, পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ সংরক্ষণের জন্য অনাপত্তি দেওয়া হলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক মোবাইলে বলেন, 'অনেকদিন আগের ঘটনা, এ কারণে খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে হবে। অনেকে জাল কাগজপত্রও কারখানায় ঝুলিয়ে রাখে। তবে আইন লঙ্ঘন করে কিছু করলে আমার অনুসন্ধান সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিব।' যদিও পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, এই বিষয়ে তারা কিছুই জানে না।
স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে জানা গেছে, এলাকার ব্যবসায়ী লতিফুল করিম বিপ্লব কাহালু উপজেলার মালঞ্চ-দুর্গাপুর ইউনিয়নের আঞ্চলিক সড়কের পাশে ২০১২ সালে একটি কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। প্রাথমিকভাবে তিনি এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের দিক তুলে ধরেন। এরপর বিদেশ থেকে টায়ার-টিউব পোড়ানো যন্ত্রপাতি এনে স্থাপন করেন সড়কের পাশে লোকালয় আর কৃষিজমি ঘেঁষে। ওই বছরের জুন-জুলাইয়ের দিকে টায়ার-টিউব আর কনডম পোড়ানো শুরু হলে ধোঁয়ার উৎকট গন্ধে এলাকার মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। সম্প্রতি খুলনা থেকে ওই কারখানায় দুই ট্রাক ব্যবহার অনুপযোগী কনডম নিয়ে আসা হয়েছে পোড়ানোর জন্য।
এরপর আগস্ট মাসের দিকে এই প্রতিষ্ঠান লোকালয় থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এলাকার শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করেন। কারখানাটি বন্ধে ২০১২ সালের ১৩ আগস্ট জন্য বগুড়ার বিভাগীয় পরিবেশ কার্যালয়ে শতাধিক মানুষ স্বাক্ষরিত একটি আবেদন পরিবেশ অধিদপ্তরে দেওয়া হয়।
আবেদনে উল্লেখ করা হয়, মেসার্স আফরোজা ফার্নেস অয়েল কারখানাটি জনগণের তীব্র আপত্তি থাকার পরেও স্থাপন করা হয়েছে। এখানে পুরাতন টায়ার-টিউব পোড়ানোর ফলে কালো ধোয়া নির্গমন হয় এবং দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। এটি পরিবেশের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে কারখানাটি আবাসিক এলাকায় হওয়ায় মানুষ বিভিন্ন রোগবালাই শুরু হয়েছে; শ্বাসকষ্ট, সর্দি, বমি বমি ভাবসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা। যার কারণে জনস্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ চরম হুমকির মুখে পড়ছে। কারখানাটির পাশের রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার লোক প্রতিনিয়ত যাতয়াত করেন। প্রতিষ্ঠানটি আবাসিক এলাকায় হওয়ায় একদিকে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের, অন্যদিকে আবাদি জমির।
এই প্রতিবাদলিপি ও মানববন্ধন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় প্রতিবাদী মানুষের কাছে। কারখানার বিরোধিতা করার জন্য ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ এ চাঁদাবাজির মামলা করা হয় ওই এলাকার ৬ জনের নাম উল্লেখ করে। অজ্ঞাত আসামি করা হয় আরও অনেককে। মামলার পর এলাকার লোকজন আতঙ্কে পড়ে যান। প্রতিবাদ করে নিজ বাড়ি থেকেই পালিয়ে বেড়াতে হয় তাদের। এর মধ্যেই আফরোজা ফার্নেস অয়েল প্রতিষ্ঠান কৌশলের আশ্রয় নেয়। বিরোধিতার প্রধান সারির এক নেতাকে চাকরি দিয়ে চাঁদাবাজির মামলা তুলে নেয় কর্তৃপক্ষ।
আফরোজা ফার্নেস অয়েল কারখানায় 'ফোর ম্যানের' চাকরি পেয়েছেন রায়হান আলী। তিনি আফরোজা ফার্নেস অয়েল প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করা মামলায় তিন নম্বর আসামী ছিলেন। পুলিশের ভয়ে দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকা রায়হান এলাকায় ফিরেছেন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে।
কারখানার মধ্যে সাংবাদিকের প্রবেশ নিয়ে ক্ষিপ্ত হলেও চাকরিতে প্রবেশের বিষয়ে নরম সুরে কথা বলেন রায়হান। জানান, 'কতোদিন আর পালিয়ে থাকা যায়। ধোঁয়া তো হচ্ছেই। তেলের কারণে তো কৃষি জমির ধান নষ্ট হয়ই। প্রতিবাদও করেছিলাম। উল্টো আমরাই মামলা খেয়েছি। পালিয়ে থেকেছি নিজ বাড়ি থেকে। অথচ পুলিশ-সাংবাদিক আর পরিবেশের লোকজন ঠিকই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে চলে যান।'
এর মধ্যেই কোম্পানি তাদের উৎপাদন কৌশলেও পরিবর্তন এনেছে। এখন ২৪ ঘণ্টা আর টায়ার-টিউব পোড়ানো হয় না। এখন বিকেল থেকে ভোর পর্যন্ত পুড়িয়ে উৎপাদন করা হয় জ্বালানি তেল। শ্রমিকরাও রাতের বেলায় কাজ করেন। তবে নারী শ্রমিকরা দিনের বেলায় কাজ করেন। নিরাপত্তা কর্মচারী রয়েছে দুইজন। এর মধ্যে একজনের দায়িত্ব দিনে। অন্যজন কোম্পানি পাহারা দেন রাতে।
এই প্রতিষ্ঠানে গত তিন বছর ধরে নিরাপত্তা প্রহরীর (রাত আটটা থেকে সকাল আটটা) দায়িত্ব পালন করেন আকবর আলী। তিনি বলেন, 'অভাবের কারণে চাকরি করতে হয়। বিভিন্ন সময় কোম্পানির বিপক্ষে কথা বলার কারণে চাকরি থেকে বাদ দিয়েছে। ফের আবার ডেকে নিয়ে আসছে। কারণ এই ধোঁয়ার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চাকরি করার লোক কই?'
অপরিশোধিত এই জ্বালানি তেল বিক্রি করা হয় বগুড়ার বিভন্ন ঠিকাদারের কাছে। এই তেল সড়ক নির্মাণের কাজেও ব্যবহৃত হয়।
বগুড়া সড়ক ও জনপথের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন, 'ডিজেল ও কেরোসিনের চেয়ে ফার্নেস ওয়েলের দাম কম হওয়ায় কেউ ব্যবহার করে থাকতে পারেন। তবে এই বিষয়টি পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ কারণে আমরা নিরুৎসাহিত করি।'
গাছপালা দিয়ে টায়ার পোড়ানোর পর উচ্ছিষ্ট গুঁড়া বিক্রি করা হয় দেশের বিভিন্ন বাজারে। এ কাজে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি। সম্প্রতি ওই কারখানায় গিয়ে ৭ সাতজন নারীর দেখা মেলে। তাদের মধ্যে একজন হলেন, লাকী আক্তার। জানান, 'পেটের দায়ে সারাদিন পরিশ্রম করি। তাতে দিনশেষে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা পাই।'
এই কালি ক্ষতিকর কিনা জানতে চাইলে লাকী বলেন, 'অনেক বছর ধরে এখানে কালি ঝাড়ার কাজ করি। এখন পর্যন্ত তেমন কোন সমস্যা হয়নি। তবে শুনেছি নিঃশ্বাসের সাথে শরীরে গেলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তার মতো আরো অনেক নারী শ্রমিকই সংসারে অভাবের তাড়নায় এখানে শরীর কালিমাখা অবস্থায় সারাদিন কাজ করেন।'
আরেক নারী শ্রমিক লায়লা বেগম বলেন, 'কালিতে তো শরীরে ক্ষতি হতেই পারে। কিন্তু অন্য কাজ তো নেই এলাকায়। কারখানায় যখন পুরাতন টায়ারগুলো পোড়ানো হয় তখন প্রচন্ড গন্ধ বের হয়। এমনকি উৎপাদিত এই তেলেরও একধরনের বাজে গন্ধ বের হয়।'
উন্মুক্তভাবে টায়ার-টিউব পোড়ালে পরিবেশে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে বগুড়ার সরকারি শাহ এতেবাড়িয়া কলেজের অধ্যক্ষ রসায়নবিদ ফারুক আহম্মেদ বলেন, 'টায়ার-টিউব পোড়ালে ব্যাপক কার্বন ডাই অক্সিজেন উৎপন্ন হয়। চিমনি উঁচু না করলে এটা সাধারণ মানুষ ও পরিবেশের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। একই সাথে এখানে উৎপাদিত বর্জ্য জমিতে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ফসল নষ্ট করে দেয়'।
দুর্গাপুর দেওগ্রাম দক্ষিণপাড়ার আজিজার রহমান বলেন, 'আমাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কারখানার মালিক বিপ্লব এখানে তার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। আমরা একাধিকবার বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দেয়ার পরও এর কোন সুরাহা হয়নি। এলাকাবাসী এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানববন্ধনও করেছে। উলটো মালিক আমাদের উপর মিথ্যা মামলা দিয়েছে'।
একই এলাকার আজিজুল জানান, 'এই কারখানার কালো ধোঁয়া আশপাশের পরিবেশ নষ্ট করছে। ফলগুলো অকালেই পচে যাচ্ছে। কারখানার বিষাক্ত তেলে জমির ধান নষ্ট হয়ে যায়। বর্জ্য আর ধোঁয়ার দুর্গন্ধে নাকাল অবস্থা। এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কারখানাটি লোকালয় ছেড়ে অন্য জায়গায় নেওয়ার জন্য অনেকবার থানায় অভিযোগ করা হয়েছে কিন্তু কোন কাজ হয়নি'।
টায়ার-টিউব পোড়ানো কারখানার খুঁটি খুব শক্ত- এমন অভিযোগ করে দুর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. বদরুজ্জামান খান বলেন, 'এর আগে এই কারখানা বন্ধে আন্দোলন হয়েছে। পরে আন্দোলনকারীরাই বিপদে পড়েছেন। এই কারণে এলাকার লোকজন আর সাহস পান না। আমি ইউএনওকে বলেছিলাম। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।'
আফরোজা বার্নিং ওয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের সহকারি ব্যবস্থাপক শাহিন আলম। তিনি জানান, 'এই কারখানটি চীনা কারিগরি প্রযুক্তিতে সম্পূর্ণ বর্জ্য ও পরিবেশ দূষণমুক্তভাবে চলছে। পরিবেশ বজায় রাখার জন্য এখানে শুধু রাতে কাজ করা হয়। আশপাশের বসবাসরত মানুষের যেন কোন ক্ষতি না হয় সেদিকটা বিবেচনা করেই এখানে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। টায়ার-টিউব পোড়ানো তেল বিক্রয় করা হয় প্রতি লিটার ৪৮ টাকা দরে।'
এই প্রতিষ্ঠানের মালিকের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বগুড়ার টায়ার-টিউব পোড়ানোর জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে দেওয়া হয় নি বলে জানিয়েছেন এই সংস্থার বিভাগীয় পরিচালক সুফিয়া নাজিম। তার ভাষ্য, 'এই প্রতিষ্ঠানে আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি। তবে আফরোজা বার্নিং ওয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ সম্পর্কে কোনো তথ্য আমাদের কাছে ছিল না। এমনকি তাদের পরিবেশের কোনো নিবন্ধনও নেই। তাদের বিরুদ্ধে খুব দ্রু্তই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'