পুরোদমে চলছে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ, বাড়ছে প্রত্যাশা
চট্টগ্রামের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। করোনাভাইরাস বাস্তবতায় কাজের গতি কিছুটা কমলেও বর্তমানে পুরোদমে চলছে এই প্রকল্পের কাজ।
সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই প্রকল্প আগামী ২০২৩ সালের জুনে যান চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে প্রত্যাশা করছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
যানযট পেরিয়ে লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর ও পতেঙ্গা সৈকতে যেতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। বিমানযাত্রীরা সময়মতো বিমানবন্দরে পৌঁছাতে না পারায় ফ্লাইট মিস হওয়ার ঘটনা ঘটে অহরহ। এ কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রামে আসতে অনীহা প্রকাশ করেন।
এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এসব দুর্ভোগ আর থাকবে না বলে আশা করা হচ্ছে। যে গন্তব্যে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগত, সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১৫ থেকে ২০ মিনিট।
প্রকল্পটি কর্ণফুলী টানেলের সঙ্গে সংযুক্ত হলে এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব আরও বহুগুণ বাড়বে। সৃষ্টি হবে নতুন নতুন বিনিয়োগ। বিকশিত হবে এ অঞ্চলের পর্যটন খাত।
এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এবং সিডিএ'র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ ৬০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ৩৭৯টি পিলারের মধ্যে ২৫০টি পিলার নির্মাণের কাজ শেষ। আগামী ২০২৩ সালের জুন নাগাদ এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।'
এই প্রকল্পের পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জমি কেনা বাবদ প্রকল্প ব্যয় আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। তবে কী পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
সিডিএ সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক সভায় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন পায়। সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের প্রকল্পটির কাজ ৩ বছরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে এসে ৫৪ ফুট প্রশস্ত এই এক্সপ্রেসওয়ের পিলার পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। সিডিএ'র এই প্রকল্প যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র্যাঙ্কিন।
সাড়ে ১৬ কিলোমিটারের এই এক্সপ্রেসওয়েকে লালখান বাজার থেকে দেওয়ানহাট, দেওয়ানহাট থেকে বারিক বিল্ডিং মোড, বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং, সল্টগোলা থেকে সিমেন্ট ক্রসিং, সিমেন্ট ক্রসিং থেকে কাঠগড়, কাঠগড় থেকে ভিআইপি রোড এবং সি বিচ থেকে ভিআইপি রোড পর্যন্ত বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
পুরো এক্সপ্রেসওয়ের ৯টি এলাকায় গাড়ি ওঠা-নামার জন্য ২৪টি র্যাম্প থাকবে। এরমধ্যে টাইগারপাস এলাকায় চারটি, আগ্রাবাদে চারটি, বারিক বিল্ডিং মোডে দুটি, নিমতলী মোডে দুটি, কাস্টমস মোডে দুটি, সিইপিজেডে চারটি, কেইপিজেডে দুটি, কাঠগড়ে দুটি, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় থাকবে দুটি র্যাম্প। প্রতিটি র্যাম্প হবে দুই লেনের এবং একমুখি।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম টিবিএসকে বলেন, 'প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিমানবন্দর সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরের বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ১৫ মিনিট। বর্তমানে এই সড়কে সীমাহীন যানজটের কারণে বিদেশি ক্রেতারা চট্টগ্রামে আসতে আগ্রহ দেখান না। এটি এই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিনিয়োগে বড় বাধা। তবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে এ বাধা দূর হতে চলেছে। চট্টগ্রাম নগরীর দীর্ঘদিনের সমস্যা যানজট নিরসনের পাশাপাশি নতুন নতুন বিনোযোগের ক্ষেত্র তৈরি হবে। বিশ্ব বাণিজ্যে চট্টগ্রাম তথা দেশের ইমেজ বাড়বে।'
প্রকল্প এলাকার পাশ দিয়ে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, চট্টগ্রাম ইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড, ছয়টি বেসরকারি অফডক-সহ রয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এই সড়ক দিয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। প্রতিদিন সকালে এই অঞ্চলের কারখানায় কর্মরত কয়েক লক্ষ কর্মকর্তা- শ্রমিককে সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অফিস শেষে বাসায় ফিরতেও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাদের। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হলে অফিসগামীদের কষ্ট লাঘব হবে আশা করা হচ্ছে।
এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনস ইনভেস্টর'স অ্যাসোসিয়েশন (বেপজিয়া) চট্টগ্রাম জোনের ট্রেজারার এস এম আবু সুফিয়ান টিবিএসকে বলেন, 'চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী ইপিজেডে প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। শুধুমাত্র যানজটের কবলে প্রতিদিন গড়ে শ্রমঘণ্টার এক ঘণ্টা নষ্ট হয়। এতে শ্রমিদের দুর্ভোগের পাশাপাশি কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়। আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনেও পোহাতে হয় ভোগান্তি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হয়ে গেলে অথর্নীতির উন্নয়নে বড় ধরনের অগ্রগতি হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।'
তবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরুর পর থেকে প্রকল্প এলাকার লালখান বাজার থেকে টাইগারপাস মোড পর্যন্ত আধা কিলোমিটার অংশ বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। ২১ জুন টাইগারপাসে এলিভেটেড নির্মাণ না করতে সিডিএকে চিঠিও দেয় চসিক। প্রকল্প বাস্তবায়নে পাহাড় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নষ্ট না করার একই দাবিতে মানবন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
অবশ্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলছে, যেহেতু একনেকে প্রকল্প অনুমোদনের পর নকশায় কোনো পরিবর্তন হয়নি, তাই এই প্রকল্প থেকে টাইগারপাস অংশ বাদ দেওয়ার আপাতত কোনো সুযোগ নেই। এক্সপ্রেসওয়ে যদি লালখান বাজার পর্যন্ত না এনে টাইগারপাস এলাকায় নামিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে লালখান বাজার থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত এলাকায় দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হবে। তখন এই প্রকল্পের সুফল ব্যাহত হবে। এ কারণে মূল এক্সপ্রেসওয়ে থেকে র্যাম্প আকারে দুটি অংশ লালখান বাজার নামবে। অপর দুটি অংশ সরাসরি ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সঙ্গে যুক্ত হবে। দুটি মিলে তখন এর দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে সাড়ে ২২ কিলোমিটার।
লালখান বাজার থেকে টাইগারপাস অংশে পাহাড় ও গাছ কাটা পড়বে না বলে দাবি করেন সিডিএ'র প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।