পোশাক শিল্পের বড় ব্র্যান্ডগুলোর এখনও বাংলাদেশি শ্রমিকই দরকার
জনজীবনে স্বাভাবিক ছন্দপতনের করোনাভাইরাস লকডাউনের দ্বিতীয় মাসে পা রেখেছে বাংলাদেশ, বন্ধ আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণ-পরিবহন এবং বেশিরভাগ কর্মস্থল। কিন্তু, দেশটির গার্মেন্টস উৎপাদকদের লবিংয়ের দৌলতে এর মধ্যেও সচল আছে পোশাক কারখানা, এখনও দৈনিক কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে লাখ লাখ শ্রমিক, যাদের অধিকাংশই মজুরি কর্তন বা সময়মতো পরিশোধ না করা এবং অপর্যাপ্ত কোভিড সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ তুলেছে।
অথচ ১,১০০- এর বেশি জীবন কেড়ে নেওয়া কুখ্যাত রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির আট বছর পর এসে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল। কারণ, ওই দুর্ঘটনার পরই বৈশ্বিক অ্যাপারেল ব্র্যান্ডগুলো স্থানীয় কারখানার সঙ্গে করে সুরক্ষা চুক্তি, যা সত্যিকারের অগ্রগতি করেছে। কিন্তু, একমাত্র সমস্যা হলো, এসব চুক্তির একটি ২০১৮ সালেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে এবং আরেকটি চলতি বছরের ৩১ মে' শেষ হবে।
সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো, চুক্তিগুলোর মেয়াদ পেড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান কালের মতো দুঃসময় আর হয় না। বিশ্বজুড়ে ভাইরাসের আতঙ্ক ও বিনাশে সঙ্কুচিত পোশাক শিল্পের ক্রেতা চাহিদা; যার কারণে কারখানাগুলো করছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকারেরও আছে সীমিত পরিমাণ সাহায্য দেওয়ার সামর্থ্য। মালিকপক্ষের এই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভার এখন তাই শ্রমিকদের কাঁধে। এই অবস্থায় বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও রিটেইলারদের সাহায্য ছাড়া শ্রমিকেরা তাদের বহুকষ্টে অর্জিত স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য নিরাপত্তা হারাবে- যা আলোচিত চুক্তিগুলো নিশ্চিত করেছিল। ফলে আরও মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানির অর্থনীতিকে আধুনিক যুগের এক বিস্ময়ই বলা যায়। ১৯৭৮ সালেই দেশটির অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিল শুধুমাত্র কৃষিখাত; ওই সময়ে সর্বসাকুল্যে পোশাক কারাখানার সংখ্যা ছিল ৯টি, যাদের রপ্তানি আয় ছিল ১০ লাখ ডলার। কিন্তু, পরবর্তী ৩০ বছরে চৌকস উদ্যোক্তা শ্রেণি, সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তি এবং বিদেশি রিটেইলারদের খরচ সাশ্রয়ী মনোভাব এই খাতের দৃশ্য নাটকীয়ভাবে বদলে দেয়। ২০২০ সাল নাগাদ গার্মেন্টস শিল্পের বাৎসরিক রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৩,৩৬০ কোটি ডলারে। আর ৪,০০০ হাজারের বেশি কারখানায় কাজ করছিলেন প্রায় ৪৪ লাখ শ্রমিক।
যদিও চকচকে সাফল্যের নেপথ্যে ছিল কিছু রূঢ় ও কুৎসিত বাস্তবতা। যেমন; রানা প্লাজা ধসের সময় সদ্য কাজে যোগ দেওয়া একজন শ্রমিকের মাসিক বেতন ছিল ৪০ ডলারেরও কম। কর্মপরিবেশও ছিল মারাত্মক রকমের দুর্ঘটনাপ্রবণ। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির আগের আট বছরে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১,০০০ হাজারের বেশি শ্রমিক। কিন্তু, তা সত্ত্বেও পোশাক শিল্পের বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বাংলাদেশের আকর্ষণ কমেছে এমনটা কখনোই মনে হয়নি।
বেনেটনের মতো ইউরোপের প্রথম সাড়ির ব্র্যান্ডগুলোকে পোশাক সরবরাহ করতো রানা প্লাজায় অবস্থিত কারখানাগুলো, তাই সেখানে ওই মারাত্মক দুর্ঘটনাই সবকিছু বদলে দেয়। কয়েক দশক ধরে পরিধেয় বস্ত্রের দাম কমা নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার যেসব ভোক্তারা মোটেও প্রশ্ন তোলেননি, তারাও এবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন। ভোক্তা বিদ্রোহের এই শঙ্কা থেকেই দ্রুতলয়ে কর্ম-পরিবেশ উন্নয়নে ব্যতিব্যস্ত হয় পোশাক শিল্প। এরপর কারখানা পরিদর্শন, অবকাঠামো মেরামত এবং ফ্যাক্টরি উন্নতকরণের যৌক্তিক সুরক্ষা মান যুক্ত দুটি চুক্তি প্রণীত হয়।
সবচেয়ে সফল চুক্তি ছিল; অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ শীর্ষক চুক্তিটি। ক্রেতা ব্র্যান্ড এবং ইউনিয়নগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিতে উভয়পক্ষকেই নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানের পরিচালনা পর্ষদে সমান সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হয়। অবশ্য এতে সরাসরি কারাখানা পর্যায় যুক্ত ছিল না। তবে এর মাধ্যমে কোনো সরবরাহক কারখানা স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা মানসম্মত কিনা এবং উন্নয়ন ও মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করছে কিনা- তা বিবেচনা করে ক্রেতা ব্রান্ডগুলোর ক্রয় অর্ডার দেওয়াকে বাধ্যতামূলক করা হয়। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি কাঠামো এবং প্রয়োজনীয় ছুটিও ছিল উন্নয়ন শর্তের অংশ। এই সমঝোতা হওয়ার প্রথম পাঁচ বছরেই প্রায় ১,৫০০ কারাখানায় এক লাখের বেশি নিরাপত্তা উন্নয়ন সম্পন্ন হয়।
চুক্তির অর্জন অসাধারণ হলেও, অ্যাকর্ডকে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবেই প্রণয়ন করা হয়েছিল। এখন কোন ধরনের ব্যবস্থা একে প্রতিস্থাপন করবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ।
তবে কারখানা প্রতিনিধিদের যুক্ত করাসহ টেকসই প্রশাসক কাঠামো প্রণয়নে গত বছর ব্র্যান্ড ও ইউনিয়নগুলো একটি নতুন চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হয়। সেখানে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে কারাখানা পরিদর্শন ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকারের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিও ছিল।
পুরোনো চুক্তিগুলোর মেয়াদ পেড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ব্যবস্থাটি কার্যকরের সময় যখন এগিয়ে আসছে, তখন ক্রেতা ব্র্যান্ড এবং শ্রম ইউনিয়নগুলো শঙ্কা করছে, ব্র্যান্ডগুলোর বাধ্যতামূলক অঙ্গীকার না করলে কারাখানা মালিকেরা চুক্তি স্বাক্ষরে আগ্রহী হবে না।
মহামারির আগে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প সংক্রান্ত মার্কিন সিনেট কমিটির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে, কারাখানা শ্রমিক ও শ্রম ইউনিয়নগুলোর ক্রমাগত হুমকি এবং নির্যাতনের মুখে থাকার দিকটি। কারণ, সকল প্রকার অগ্রগতির পরও এখন শত শত কারখানায় রয়েছে জরুরি বহিঃগমন দ্বার, স্মোক অ্যালার্ম এবং অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্রপাতির ন্যায় মৌলিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অভাব।
মহামারি সেই দশার আরও অবনতি করেছে। ব্র্যান্ডগুলোও কারাখানা মালিকদের ব্যয়বহুল কোভিড সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। অথচ তারাই আবার ৪০ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল অথবা স্থগিত করে। এতে কারখানাগুলো যে ক্ষতির মুখে পড়ে- তার জন্য নগদ অর্থ বা অন্য কোনো রকম সহায়তা দানের দৃষ্টান্ত ছিল খুবই কম, এবং পারতপক্ষে না থাকারই শামিল।
এই অবস্থায় কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার নতুন চুক্তি এবং ব্র্যান্ডগুলোর তরফ থেকে আরও যৌক্তিক আর্থিক সহায়তা ছাড়া; ইতোমধ্যেই আর্থিক সঙ্কটে পড়া কারখানা পর্যায় ব্যয়বহুল নিরাপত্তা ব্যবস্থা রক্ষা করতে পারবে বলে আস্থা রাখা যায় না।
অ্যাকর্ড চুক্তি নবায়নে এপর্যন্ত ব্র্যান্ডগুলো খুবই কম আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং গার্মেন্টস শিল্প মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগপর্যন্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে, তাদের অন্তত আগ্রহী হওয়া উচিৎ। একবার চুক্তিটির নবায়ন হলে পরবর্তীতে এটি ধাপে ধাপে আরও সর্বাঙ্গীণ চুক্তির মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব; যেখানে ব্র্যান্ডগুলো যেমন তাদের সরবরাহকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা মান বজায় রাখাকে বাধ্যতামূলক করবে, ঠিক তেমনি থাকতে হবে কারখানা প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার অংশগ্রহণ। এসব কর্তৃপক্ষ মিলিতভাবে কারাখানা পরিদর্শন ও সুপারভাইজের দায়িত্বে থাকবে।
বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো যখন কর্মপরিবেশ নিরাপদ করার বিষয়ে মনোযোগী হয় না তখন কী হতে পারে, রানা প্লাজাই সেই শিক্ষা। পুনরায় এমন ট্র্যাজেডির মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ কারোই কাম্য হওয়া উচিৎ নয়।
- লেখক: ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট অ্যাডাম মিন্টার। তার লেখা বহুল আলোচিত গ্রন্থ "দ্য জাঙ্কইয়ার্ড প্ল্যানেট: ট্রাভেলস ইন দ্য বিলিয়ন ডলার ট্র্যাশ ট্রেড" এবং "সেকেন্ডহ্যান্ড: ট্রাভেলস ইন দ্য নিউ গ্লোবাল গ্যারাজ সেল" প্রভৃতি।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত