ফারাক্কা: ভারতের জন্য বুমেরাং
নিঃসন্দেহে গত পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশের অনেক দুর্ভোগের মূলে রয়েছে ফারাক্কা বাঁধ। তবে এখন ভারতেরও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে বাঁধটি। কারণ বিহার, উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিবঙ্গের কিছু এলাকায় বন্যার প্রকোপ বেড়েছে ফারাক্কার কারণে। নদীভাঙনসহ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান ধ্বংসের জন্যও ভারতে এ বাঁধকে দায়ী করা হচ্ছে। সেখানকার নদীগুলোতে এখন আর ইলিশের দেখা মেলে না। যেটি বাস্তুসংস্থানে এক ব্যাপক পরিবর্তনের ফল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৯৭৬ সালের ১৬ মে ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে পরিচিত প্রয়াত রাজনীতিবিদ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত সেই ঐতিহাসিক লং মার্চের কথা মনে আছে অনেকেরই। বিতর্কিত বাঁধটি চালুর প্রতিবাদ জানাতে তিনি ফারাক্কা-অভিমুখী মার্চের ডাক দিয়েছিলেন। হাজার হাজার মানুষ তাতে অংশ নেন।
ভারত ও বাংলাদেশের উপর দিয়ে বহমান গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দিয়ে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ছিলেন মওলানা ভাসানী ও লংমার্চের অনুসারীরা। ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশে গঙ্গার ভাটি অঞ্চলে বাস্তুসংস্থানের সম্ভাব্য ক্ষতি ও পানিপ্রবাহের বিষয়টি নিয়েও চিন্তিত ছিলেন তাঁরা।
ভাসানীর ওই লং মার্চের আগে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একসময়কার প্রধান প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্যও ফারাক্কা বাঁধটি নির্মাণের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে ‘সিল্টিং অব ক্যালকাটা পোর্ট’ শিরোনামের এক রিপোর্টে তিনি লিখেন, বাঁধটি তৈরির আগে বন্যার প্রাবল্য ও বন্যা-প্রসূত পলি-সৃষ্টির বিপদ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে না।
রিপোর্টে তিনি আরও লিখেছেন, “ফারাক্কার কারণে কলকাতা বন্দর মরে গেছে। প্রধান নিষ্কাশন ব্যবস্থাগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় বার বার বন্যার আশঙ্কাও বাড়তে থাকবে।”
ফারাক্কা নিয়ে তাঁর সতর্কবাণী আমলে না নিলে মানুষকে ভবিষ্যতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হবে বলেও উল্লেখ করেন কপিল।
দেখা যাচ্ছে, কপিলের সব আশঙ্কাই এখন বাস্তব।
কপিলের আশঙ্কা যেভাবে সত্য হল
২.৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার উজানে। মূল উদ্দেশ্য ছিল কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা তথা সেখানে পলির স্তর জমতে না দেওয়া। সে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পানীয় জলের জোগান বজায় রাখা।
ষাটের দশকে কপিলের সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বাঁধটি বরং নদীর তলদেশে পলির স্তর বাড়াবে। কারণ শুকনো মৌসুমে বাঁধের কাছে পাওয়া যাবে অর্ধেক পরিমাণ পানি যেটুকু হুগলির দিকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব। সে কারণেই বাড়বে পলি। আর বাংলাদেশেও কমে যাবে গঙ্গার পানিপ্রবাহ।
কপিল স্পষ্টভাবেই লিখেছিলেন, বাঁধের নকশাটি এমনভাবে তৈরি যে, বন্যা দেখা দিলে খুব কম পানি সরিয়ে নেওয়া যাবে। ফলে গঙ্গা অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যেমন পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদসহ বিহারের বেশ কিছু জেলায় ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা থেকে যাবে।
সে সময় এসব সাবধানবাণী উচ্চারণের জন্য কপিলকে পাকিস্তানের চর হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে ভারতের একটি গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী কপিলের তিনটি সতর্কবাণী এখন সত্য হয়েছে। সে বছর বিহারে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে মূখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার দাবি জানান।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার খবরে প্রকাশ, নীতিশ তখন বলেছিলেন, “বিহারের এই বন্যার কারণ গঙ্গায় ফরাক্কার নির্মাণের ফলে নদীতে জমে যাওয়া পলি। এ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় একটাই, বাঁধটা সরিয়ে নেওয়া।”
কেন্দ্রীয় সরকার যেন বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কার মাধ্যমে গঙ্গার উজান থেকে যতটুকু সম্ভব পানি সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা নেন, গত কয়েক বছর ধরে নীতিশ কুমার সেজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সেটি হলে বিহার রাজ্যের নদীবিধৌত এলাকাগুলোতে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা কেটে যাবে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার গত সপ্তাহের রিপোর্ট, এই বর্ষাতেও পাটনাসহ বিহারের মোট বারোটি জেলায় গঙ্গার পানি উপচে বন্যার সৃষ্টি হওয়ায় নীতিশ একইভাবে চেষ্টা করছেন। নীতিশের সঙ্গে তাঁর পানিসম্পদ মন্ত্রী সঞ্জয় কুমার ঝা রয়েছেন। বিহারে বন্যার পানি পুরোপুরি সরে না যাওয়া পর্যন্ত ফারাক্কা দিয়ে নিয়মিতভাবে কমপক্ষে ১৮ লাখ কিউসেক (কিউবিক মিটার পার সেকেন্ড) পানি সরানোর ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে আহ্বান জানান তাঁরা।
একই মিডিয়ার ৩০ সেপ্টেম্বরের খবরে প্রকাশ, বিহারের আইনপ্রণেতাদের বারবারের আবেদনের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ফারাক্কার ১১৯টি গেটের সবগুলোই খুলে দিয়েছে।
এর ফলে আবার গঙ্গার নিম্ন অববাহিকা অঞ্চলে পদ্মার পানির স্তর উঁচুতে উঠে গেছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজশাহী অফিস জানাচ্ছে, আগামী কয়েক দিনে পানির উচ্চতা ১৮.৫ সেন্টিমিটারের উপরে উঠে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। ইউএনবি জানাচ্ছে, তাতে বন্যার আশঙ্কা বাড়ছে।
তবে ৩০ সেপ্টেম্বরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ফারাক্কার গেইটগুলো খোলা থাকে। এটা বাঁধ ব্যবস্থাপনার সাধারণ পদ্ধতি।
যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি কে এম আনোয়ার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, শুকনো মৌসুমে পানি পাবার জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টনের চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। যে চুক্তির ফলে বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধ থেকে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
বিহার ও উত্তর প্রদেশের বন্যার প্রসঙ্গ টেনে আনোয়ার বললেন, “বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ভারতের একটি রাজ্যকে সুবিধা দিতে পারে। কিন্তু এটা অন্যসব ভারতীয় রাজ্যের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে।”
ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা
১৯৯৬ সালের ফারাক্কায় গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত প্রতিবারে দশ-দিন করে ৩৫ হাজার কিউসেক পরিমাণ পানি পাবে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াটার কাউন্সিলের ওয়াটার পলিসি এ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে এ বছর। এর শিরোনাম, ‘আ ক্রিটিক্যাল রিভিউ অব দ্য গাঙ্গেস ওয়াটার শেয়ারিং অ্যারেঞ্জমেন্ট’। সেখানে বলা হয়েছে: চুক্তি-পরবর্তী উপাত্তের (১৯৯৭-২০১৬) স্ট্যাটিসটিক্যাল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পানির চাহিদা যখন তীব্র থাকে, সেই সংকটময় শুকনো মৌসুমে ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রতিশ্রুত পরিমাণ পানি পায় না।”
১৯৭৫ সাল থেকে ফারাক্কার উজান থেকে পানি টেনে নিয়ে যাওয়ার ফলে, বিশাল বরেন্দ্রভূমি অঞ্চলসহ পদ্মা ও তার উপনদীগুলোর অববাহিকায় ভূগর্ভস্থ এবং উপরিভাগের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বোরো ফসলের আবাদ এবং বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শুকনো মৌসুমে পদ্মার অন্যতম উপনদী ও ‘সুন্দরবনের লাইফলাইন’ নামে পরিচিত পশুর নদী শুকিয়ে যায়। তখন এর উজানে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে।
ফারাক্কা কি অভিশাপ?
ভারতের নিউজ এজেন্সিগুলোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে প্রকাশ, শোন নদীর উপর নির্মিত ইন্দ্রপুরী বাঁধ থেকে মাত্র ২.৭৫ লাখ কিউসেক পানি ছেড়ে দেবার ফলে গঙ্গার অবস্থা গুরুতর হয়ে ওঠে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ফারাক্কা দিয়ে ভাটিতে ১৮ লাখ কিউসেক পানি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
ওদিকে, প্রাপ্ত তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, মধ্য প্রদেশে শোন নদীর ওপর নির্মিত বনসাগর বাঁধ থেকে হঠাৎ পানি ছেড়ে দেওয়ার ফলেই ২০১৬ সালে বিহারে ওই ভযাবহ বন্যা দেখা দেয়।
দেখা যাচ্ছে, বিহারের মূখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার যথার্থই বলেছেন, উজানে ফারাক্কা নদীর স্বাভাবিক পলিপ্রবাহে যে বাধার সৃষ্টি করছে সেজন্য বাঁধটি সরিয়ে নেওয়াই উত্তম।
২০১৬ সালের বিহারের বন্যার পর রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে গঠিত কমিটির কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। তাতে বলা হয়, ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য দায়ী ফারাক্কা। এই বাঁধের প্রভাবে পাটনা ও ভাগলপুরের মধ্যে গঙ্গার উজানে পলির স্তর পুরু হচ্ছে।
রাজ্য সরকার কোলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের উপাত্তও ব্যবহার করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ফারাক্কা তৈরির আগে বছরে ৬.৪০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পলি ড্রেজিং করা হত। যা ২০০৩ সালে চার গুণ বেড়েছে।
রাজ্য সরকার তাই প্রতিবেদনের উপসংহার টেনেছে এভাবে, “ফারাক্কা কোনো কাজেই লাগছে না… বরং চালু থাকায় এটি নিজেই অনেকগুলো বন্যার কার্যকারণ হয়ে উঠছে।”
ফারাক্কার আরও অন্যান্য অসুবিধার পাশাপাশি রাজ্য সরকার এটির প্রভাবে সামুদ্রিক প্রাণিকুলের এবং প্রধানত ইলিশের আবাসস্থল ও সাধারণ চক্রগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যাবার কথা বলেছেন।
ম্যাগসেসে পুরস্কারজয়ী রাজেন্দ্র সিং ফারাক্কাকে বিহারের জন্য অশুভ বলে মনে করেন। এই অভিশাপটি সরিয়ে নেবার কথাও বলেছেন ‘ওয়াটারম্যান’ হিসেবে খ্যাত ভারতীয় এই পানি-সংরক্ষণবিদ ও পরিবেশবাদী।
বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গ্যানাইজেশনের সাবেক মহাপরিচালক এম ইনামুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, “উজানে পলিস্তর বৃদ্ধির পাশাপাশি, ফারাক্কা বাঁধ পশ্চিবঙ্গের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভগীরথী নদীতে ভয়াবহ ভাঙনের কারণ হচ্ছে।”
“এই বাঁধ কেবল বাংলাদেশকে প্রভাবিত করছে তা নয়, ভারতের নদী-অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানেও পরিবর্তন ঘটাচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখে টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টে জানা যায়, ইলিশের ঝাঁক তাদের চলার পথ বদলে হুগলির মোহনা থেকে বাংলাদেশের মেঘনার দিকে আসছে। এর কারণ নদীর নিচে পলির পুরু স্তর। ২০০২ সাল থেকে গত দেড় দশকে পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ ধরা পড়েছে মাত্র ২৭,৫৩৯ টন। মানে, এ সময়ে সেখানে ইলিশ ধরার হার প্রায় ৫৬ শতাংশ কমেছে।
একই সময়ে বাংলাদেশে ইলিশের ধরা পড়ার হার বেড়েছে ১৬০ শতাংশ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ তথ্য জানালেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান।
নদীর নিচে কমপক্ষে ১৫ ফুট গভীর পানিতে ইলিশ সাঁতরে বেড়াতে পছন্দ করে বলে জানালেন আনিসুর। নদীতে পলিস্তর পুরু হবার ফলে ইলিশের ঝাঁক তাদের গতিপথ বদলে ফেলছে।
সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান উৎপল ভৌমিক টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন, হুগলির মোহনার মুখটি দ্রুতই গভীরতা হারাচ্ছে, মূলত ফারাক্কা বাঁধ চালু থাকায় এবং এ নদীতে যথাযথ ড্রেজিং না হবার ফলে।
ওদিকে, ভারতীয় পত্রপত্রিকাগুলোর খবরে প্রকাশ, দুর্গা পুজা উদযাপনের জন্য ভারতকে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ এনে চাহিদা পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারও বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে পুজা উপলক্ষে এ মাসে ইলিশের রপ্তানি ৫০০ টনের বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে।