ছোট হয়ে আসছে হাওরের গ্রাম, বদলে যাচ্ছে মানচিত্র
ভাঙনের ঘটনা নেত্রকোনার হাওরে নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলের মানুষ ভাঙনের হুমকি মোকাবলো করে আসছ। এই ভাঙন মোকাবেলায় তাদের বড় সহায় ছিল প্রকৃতি। কিন্তু প্রকৃতির সহায়কে তারা নিজেরাই ধ্বংস করেছে। ফলে তুমুল র্বষা এখন তাদের কাছে হাজির হয় সর্বস্ব হারানোর ভয়াল আতঙ্ক হয়ে।
এক সময় হাওরে জন্মানো ঘাস দিয়ে তারা বর্ষার ভাঙন মোকাবেলা করেছে, বংশ পরম্পরায়। আর এখন, হাওড়ের কোথাও এই ঘাস আর জন্মায় না।
বর্ষার 'আফাল'
বর্ষা এলেই নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার ছয় ইউনিয়নের অন্তত ৬০টি গ্রাম ভাঙনের মুখে পড়ে। এই চিত্র প্রতিবছরের। ফলে গ্রামগুলো ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। বিলীন হচ্ছে একের পর এক বসতভিটা। প্রতি র্বষায় ভিটেমাটি হারা হচ্ছেন অগণিত মানুষ। উপজেলার মানচিত্র বদলাচ্ছে। গত কয়েক দশকে সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে গেছে প্রায় ২৩টি গ্রাম ও কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। খালিয়াজুড়ির মানচিত্রে এসব গ্রাম, ঘরবাড়ি আর খুঁজে পাওযা যাবে না। এমনও আছে নথিতে নাম আছে কিন্তু এখন আর সেসব গ্রামের অস্তিত্ব নেই।
নেত্রকোনার খালিয়াজুরী হচ্ছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে নিম্নাঞ্চল। বছরের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত- ছয়মাস বর্ষাকাল থাকে এই অংশে। তখন গ্রামগুলো ছোট ছোট একেকটা দ্বীপের মতো পানিতে ভাসে। এ সময় হাওরে সামান্য বাতাসেই প্রচণ্ড ঢেউ ওঠে। তিন-চার ফুট উঁচু এক একটি বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে হাওরের গ্রামগুলোয়, তখন ভাঙনে চোখের সামনে বিলীন হয়ে যায় বসতভিটা। বর্ষার ঝড়ো বাতাস ও বিশাল ঢেউয়ের কারণে সৃষ্ট এই দুর্যোগকে হাওরের বাসিন্দারা বলে- 'আফাল'। গোটা হাওরাঞ্চলেই 'আফাল' এক আতঙ্কের নাম।
দ্বীপের মতো গ্রামগুলো যেন বস্তি
খালিয়াজুরীর সবুজ গ্রামগুলো বলা হয় হাওরদ্বীপ। কিন্তু এসব দ্বীপের ভেতরে ঢুকলে যে কারো ভুল ভাঙবে। সবচেয়ে ভাঙনকবলিত খালিয়াজুড়ির ছয় ইউনিয়েনের দ্বীপসদৃশ একেকটি গ্রাম আসলে বস্তীতে রূপ নিয়েছে এখন। আগের তুলনায় এই ছয় ইউনিয়নের উপর দিয়ে গত পাঁচ বছরে ঢেউয়ের তাণ্ডব বেড়েছে। ঢেউয়ের বাধা হয়ে থাকা অনেক গ্রাম এ সময়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আফালে ভিটেমাটি হারা বেশিরভাগ মানুষ এখনও টিকে আছে এমন গ্রামগুলোতেই আশ্রয় নেয় বা মাথা গুজে কোনো রকমে। ফলে গ্রামগুলো দিনে দিনে নতুন নতুন খুপরিসদৃশ ঘরবাড়িতে ক্রমশ বস্তির মতো ঘিঞ্জি বা ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে ওঠছে। সামান্য মাথা গোঁজার জায়গা পেতে এসব গ্রামে জমির দামও আকাশ ছোয়া।
খালিয়াজুড়ির আক্রান্ত ইউনিয়নগুলোয় এখন বাড়ির ভিটেমাটি বেচাকেনা হয় হাতের মাপে, অর্থাৎ পাঁচহাত, দশহাত জায়গা এভাবে হিসেব করে। এখানকার এক শতাংশ জায়গার দাম এখন কমপক্ষে এক থেকে দেড় লাখ টাকা -- যা খালিয়াজুড়ি উপজেলা শহরের জায়গার দামের কাছাকাছি।
বিলুপ্ত ঘাস
ভাঙনের ভুক্তভোগী শিকদারসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় কীভাবে খালিয়াজুড়ির হাওরবাসীরা নিজেদের সুরক্ষার প্রাকৃতিক উপায় ধ্বংস করেছে। আগে বর্ষাকালে হাওরে 'চাইল্যা' নামের জলজ ঘাস সর্বত্র পাওয়া যেত। এসব চাইল্যা ঘাসই ছিল হাওরবাসীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কম পচনশীল শক্তপ্রাণ এ ঘাস পানি কি শুকনো মৌসুমেও বেঁচে থাকত স্বচ্ছন্দে। বরং পানি পেলে আরও সতেজ হয়ে উঠত। হাওর অঞ্চলের মানুষ বাড়ির চারপাশে বর্ষার ভাঙন প্রতিরোধে এই ঘাস ব্যবহার করে এসেছে যুগ যুগ ধরে। মাটি আর বাঁশের বেড়ার ফাকে বাধের মাটি আঁকড়ে ধরে রাখতো চাইল্যা ঘাস। ফলে হাওর থেকে দল বেধে সংগ্রহ করা চাইল্যা ঘাসের সঙ্গে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে গ্রামগুলোর অস্থায়ী বাধ তৈরি হত, ঢেউয়ের আঘাত ঠেকাতে। কিন্তু প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে হাওরে চাইল্যা ঘাসের আর দেখা মেলে না। এই জলজ ঘাসটি কয় বছরের মধ্যে পুরোই উজাড় হয়ে গেছে হাওর থেকে। কেন চাইল্যা ঘাস এখন আর হাওরে জন্মায় না এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। সুনির্দিষ্ট কারণ হাওরবাসীও জানাতে পারে না, তবে অধিকাংশের ধারণা, চাইল্যা উজাড় হওয়ার পেছনে কারণ অনেকগুলো: তাদের মতে, সাধারণত দীর্ঘদিনের পতিত জমিতে চাইল্যা ঘাস জন্মাতো। আর বেড়ে ওঠতো বর্ষার পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু কলের লাঙ্গলের (ট্রাক্টর) ব্যাপক প্রসারের ফলে হাওরে এখন আর পতিত জমি বলতে কিছু নেই। অন্যদিকে বেশি ফলনের আশায় এবং জমিতে অবাধে ব্যবহার করা হয়েছে সার ও আগাছানাশক ওষুধ- এ-সবের বিরূপ প্রভাবেই চাইল্যা ঘাস হাওর থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চাইল্যা নাই হয়ে যাওয়া আর অন্যদিকে বাঁশ-কাঠের দাম বৃদ্ধিও হাওরবাসীর জন্য মজবুত বাধ তৈরি অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আর হাওরাঞ্চলে বাঁশ এমনিতেও দুষ্প্রাপ্য।
হাওর জুড়ে ভাঙনের চিত্র
উদয়পুর গ্রামের মৃত বীরেন্দ্র সরকারের স্ত্রী অঞ্জলী রানী সরকার এরকমই এক ভাগ্যাহত। পুরানহাটির পুব পাশে তার বাড়ি। ছোটো গ্রাম তাদের। এবারের বর্ষার শুরুতেই ভাঙনে তার রান্নাঘরসহ তার বাড়ির একাংশ হাওরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত পাঁচ-ছয় হাজার টাকা খরচ করে বাঁশ, কাঠ আর কচুরিপানা দিয়ে বাধ তৈরি র দিয়ে বসতবাড়ির বাকি অংশ রক্ষা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এর মধ্যেই তাকে ঋণ করতে হয়েছে।
'বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যখন ঢেউ ওঠে- তখন ভয়ে শরীরে কাঁপন শুরু হয়ে যায়। দুশ্চিন্তা হয়- কখন জানি বসতভিটাটাও চলে যায়,' বলেন অঞ্জলী রানী সরকার।
একই অবস্থা জগন্নাথপুর গ্রামের আব্দুল মমিনেরও। তার বাড়িরও বেশকিছুটা অংশ ভেঙ্গে গেছে। তার পুরো বসতঘবাড়ি এখন হুমকির মুখে। তিনি বাঁশ আর খড়, গাছের ডাল দিয়ে দিয়ে বাধ দিয়েছেন। তাতে ভাঙন সাময়িকভাবে ঠেকানো গেছে, কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কিনা জানেন না। তার স্ত্রী খোদেজা খাতুন বলেন, 'আফাল যহন শুরু অয় তহন খালি আল্লারে ডাহি। আফালের ভয়ে পোলাপান লইয়া রাইতে ঘুমাইতাম হারি না।'
উপজেলার সবেচেয়ে বর্ধিষ্ণু গ্রাম হিসেবে পরিচিত কৃষ্ণপুর, সেখানে গিয়েও দেখা গেছে ভয়াবহ ভাঙনের চিত্র। গ্রাম ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে। ঢেউয়ের আঘাতে শুধু এ গ্রামই না, এবারের বর্ষায় ইতিমধ্যে ভেঙ্গে গেছে কৃষ্ণপুর গায়ের ঈদগাঁহ মাঠ, কুতুবপুর পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটিও। উদয়পুর বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বাজারটির দক্ষিণাংশও ব্যাপকভাবে ভাঙছে, এর মধ্যে হাওরে চলে গেছে বেশকিছু দোকানপাট। ভাঙছে জগন্নাথপুর বাজারও। চরপাড়া গ্রামের প্রায় ৬০টি পরিবারের বসতভিটা মাত্র কয়েকদিনে বিলীন হয়ে গেছে হাওড়ের অতল জলে।
মানচিত্রে শুধু গ্রামের অস্তিত্ব
খালিয়াজুরীর কয়েকটি গ্রামের ক'জন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক দশকে এই উপজেলার অন্তত ২৩টি গ্রাম হাওরগর্ভে বিলীন হয়েছে। তারা অনেকেই গ্রামগুলোর নাম এক নিঃশ্বাসে এখনও বলে যেতে পারেন। গ্রামগুলোর নাম –স্মৃতি এখনও তাদের মনে গেঁথে আছে।
ভূমি প্রশাসনের রেকর্ডপত্র ও মানচিত্রে এ গ্রামগুলোর উল্লেখ আছে এখনও। কিন্তু বাস্তবে এর একটিরও অস্তিত্ব নেই। যেমন, নগর ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়েছিল 'নগর' গ্রামের নামানুসারে। কিন্তু ওই ইউনিয়নে এখন আর 'নগর' নামে কোন গ্রাম নেই। আবার বসতভিটার অস্তিত্ব না থাকায় অনেক গ্রামের নাম এখন হাওড়ের নাম হয়ে গেছে। যেমন: হেমনগর, নূরপুর, নারায়ণপুর, নয়ানগর, জগদীশপুর ও কাচারিবাড়ি। এগুলো একসময় গ্রাম ছিল এখন এগুলো হাওর।
নতুন গ্রাম
দীর্ঘকালের পুরনো গ্রামগুলো হাওরের ক্রমাগত ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, কিছু গ্রাম এখনও আকারে ছোটো হয়ে টিকে আছে। তবে হাওড়ে ভাঙনের পাশাপাশি গড়ার ঘটনাও ঘটছে। হাওড়ের বুকে নতুন গ্রামও জেগে ওঠছে। খালিয়াজুরীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট এসব গ্রাম নতুন দ্বীপের মতো জেগে উঠেছে। মূলত ভাঙনে ভিটেমাটি হারা মানুষেরা একত্রিত হয়ে হাওরের মাটি কেটে গড়ে তুলছে এসব নতুন জনবসতি। গত কয়েক দশকে হাওড়ে গ্রামের তালিকায় সংযোজিত হয়েছে গাজীপুর, চাকুয়া, মেন্দিপুর, কৃষ্ণপুর আর খালিয়াজুড়ির সদর ইউনিয়নের নতুন নতুন গ্রাম।
তবে নতুন গড়ে ওঠা এসব গ্রামও হাওড়ের উঁচু আগ্রাসী ঢেউ মোকাবেলা করে চলেছে।
অকিঞ্চিৎকর উদ্যোগ
খালিয়াজুরী সদরের হাওর উন্নয়ন সংক্রান্ত নাগরিক আন্দোলনের দুই সংগঠক শফিকুল ইসলাম তালুকদার ও স্বাগত সরকার শুভ জানান, বিভিন্ন সময়ে কনসার্ন বাংলাদেশ, কেয়ার বাংলাদেশের 'সৌহার্দ্য প্রকল্প', ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের 'হিলিপ প্রকল্পের' উদ্যোগে খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়নের খালিয়াজুরী, নয়াপাড়া, কিষ্টপুর, নগর ইউনিয়নের চানপুর, গাজীপুর ইউনিয়নের দাউদপুর এবং মেন্দিপুর ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের একাংশে সিসি ব্লক (পাথর, সিমেন্ট ও বালুর মিশ্রণে তৈরি) দিয়ে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাধ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে ওই গ্রামগুলো ভাঙনের কবল থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু হাওড়ের বাকি গ্রামে কোনো উদ্যোগ নেই।
খালিয়াজুরীর উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) মোঃ ইউনুস আলী বলেন, 'দু' ধরনের প্রকৌশল প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাওরের ঢেউয়ের ভাঙন থেকে গ্রামগুলো রক্ষা করা যেতে পারে। এক ইটের তৈরি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করে, আরেকটি; পাথর, সিমেন্ট ও বালুর মিশ্রণে তৈরি সিসি ব্লক বসিয়ে। তবে সিসি ব্লকের সাইজ খুব পুরো হতে হবে। আর দরকার ব্যাপক বনায়ন, তাতে ভাঙন কিছুটা রোধ করা সম্ভব হতে পারে।'
এ ক্ষেত্রে তিনি হিজল, করচ প্রভৃতি পানিবান্ধব উদ্ভিদের কথা উল্লেখ করেন।
খালিয়াজুরী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া জব্বার বলেন, 'খালিয়াজুড়ি উপজেলাটি শুধুমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। এখানে বছরে একবার মাত্র ধান হয়। দরিদ্র গ্রামবাসীদের রক্ষায় 'স্থায়ী গ্রাম রক্ষা বাধ' ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।'
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার এএইচএম আরিফুল ইসলাম বলেন, 'গ্রামরক্ষা বাধ নির্মাণের তালিকা তৈরি করেছি। উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে, দ্রুতই সিদ্ধান্ত হবে।'
জেলা প্রশাসক কাজি মোঃ আব্দুর রহমান বলেন, 'খালিয়াজুরীর হাওরের ভাঙনকবলিত গ্রামগুলোতে প্রতিরক্ষা বাধ নির্মাণের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শীঘ্র দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হবে।'
তবে সরকারী উদ্যোগ বাস্তব হওয়ার আগেই এই বর্ষাতে হয়তো আরেকটি গ্রাম হারিয়ে যাবে হাওর।