বাগেরহাটে খাঁচায় ভেটকি চাষে সম্ভাবনা দেখছেন গবেষকরা
বাগেরহাটে প্রবাহমান নদীতে খাঁচার মধ্যে অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন ভেটকি মাছের চাষ শুরু হয়েছে। শহরের কোলঘেঁষে বয়ে চলা নদীতে পরীক্ষামূলকভাবে এই চাষ শুরু করছে বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র। সফলতারও মুখ দেখেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। চূড়ান্তভাবে সফলতা আসলে মাছ চাষীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হবে এই প্রযুক্তি। চাষীরা লাভবান হবেন অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পূর্ণ এই মাছ চাষ করে।
চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, 'বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে খাঁচায় কোরাল/ভেটকি মাছ চাষ পদ্ধতির উন্নয়ন' নামক প্রকল্পের আওতায় গেল বছর ডিসেম্বর মাসে নেট, জাল, কাঠ, বাস ও প্লাস্টিকের ড্রাম দিয়ে খাঁচা তৈরি শুরু হয়। খাঁচা তৈরি ও অন্যান্য কাজ শেষে এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ৯টি খাচায় ৯০০ কোরালের পোনা ছাড়া হয়। ৬৯ গ্রাম ওজনের কোরালের প্রতিটি পোনা এখন (২৬ জুন) ৩৫০থেকে ৪০০ গ্রামের হয়েছে। দুয়েকটি পোনা ৫০০ গ্রামেরও হয়েছে। ১৯ সেন্টিমিটার লম্বা পোনাগুলো গড়ে ৩৩ সেন্টিমিটার লম্বা হয়েছে।
তাছাড়া খাঁচায় চাষ করার ফলে এর মৃত্যুহার খুবই কম দেখা গেছে। ৯০০ পোনার মধ্যে মাত্র ১০টি পোনা মারা গেছে। যার ফলে খাঁচায় কোরাল চাষ নিয়ে ইতিবাচক সম্ভাবনা দেখছেন গবেষকরা। গেল বছর জুলাইয়ে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুন মাসে শেষ হবে। এই সময়ে কয়েকটি ধাপে মৃত্যু হার, বৃদ্ধির পরিমাণ, খাদ্যাভ্যাসসহ খাঁচায় কোরাল চাষের নানা দিক উঠে আসবে। এই প্রকল্পে গবেষণা কর্মকর্তা ছাড়াও সার্বক্ষণিকভাবে ৩ শিফটে মোঃ খুশি মিয়া, মোঃ রোমান ও মোঃ সজিব শেখ নামের তিনজন কর্মচারী কাজ করছেন। এরাই মাছের দেখভাল ও খাবার প্রদান করে থাকেন। গবেষকরা বলছেন কয়েকটি ধাপে সফলতা আসলেই চাষীদের মাঝে পাইলট প্রকল্প শুরু করা যাবে।
খাঁচার দেখভালের কাজে নিয়োজিত মোঃ খুশি মিয়া বলেন, "আমরা তিনজন পর্যায়ক্রমে এখানে দায়িত্ব পালন করি। মাছগুলোর দেখাশুনা করি। ২৪ ঘন্টাই আমাদের কাউকে না কাউকে এখানে থাকতে হয়"।
বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.এ.এস. এম তানবিরুল হক বলেন, "প্রথমত আমরা প্রবাহমান লবণাক্ত পানিতে খাঁচায় কোরাল চাষ করছি। খাঁচায় এই পোনাগুলো নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে পারছে কিনা, তাদের ওজন ঠিকমত বাড়ছে কিনা, তাদের এই খাঁচায় বড় হওয়ার সময় অন্য কোন প্রতিবন্ধকতা আসছে কিনা, এদের যে বৃদ্ধি হবে তা বাজারে বিক্রি করলে চাষী লাভবান হবে কিনা-এসব কিছু আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি"।
তিনি আরও বলেন, "আমরা খুবই আশাবাদী এই কারণে যে এখানে কোরালের পোনার মৃত্যুহার খুবই কম। খাঁচায় ছাড়া পোনাগুলোর বৃদ্ধিও অনেক ভাল। তাদের পছন্দ অনুযায়ী জীবন্ত (কার্প জাতীয় মাছের ছোট পোনা)খাবারও দেওয়া হচ্ছে। ছাড়ার সময় পোনাগুলোর গড় ওজন ছিল ৬৯ গ্রাম এবং লম্বায় ছিল ১৯ সেন্টিমিটার। চার মাস পরে আমরা যে স্যাম্পলিং করেছি সেখানে সাড়ে তিনশ থেকে চারশ গ্রাম এবং লম্বায় গড়ে ৩৩ সেন্টিমিটারের মাছ পেয়েছি। প্রবাহমান হওয়ায় খাঁচার মধ্যে পানির গুণাগুণও ভাল। প্রকল্পের নির্ধারিত সময়ে প্রত্যেক ৬ মাস পরপর নতুন পোনা ছাড়া হবে। উৎপাদিত বড় মাছ অন্য স্থানে স্থানান্তর করা হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে এই পাইলট প্রকল্পে সফলতা আসলে চাষীদের মাঝে মূল প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়া হবে"।
স্থানীয় কয়েকজন মাছ চাষী বলেন, "আমরা ঘেরে সাধারণত চিংড়ি ও কার্প জাতীয় মাছ চাষ করে থাকি। এসব ধরার সময় দু-একটি পাতারি মাছ পাওয়া যায়। এ মাছ খেতে খুবই সুস্বাদু এবং দামও অনেক বেশি। সাধারণ বাজারে কেজি ওজনের মাছ ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্তু এগুলো ঘেরে চাষ করলে অন্য কোন মাছ সাথে চাষ করা যায় না। তাই আমরা চাষ করিনা। চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এলাকার পাশের নদীতে খাঁচার মধ্যে পাতারির চাষ করা হচ্ছে। শুনেছি খাঁচার মধ্যে ভালই হচ্ছে পাতারি মাছ। এভাবে যদি চাষ করা যায় তাহলে আমাদের মৎস্য ঘের ও পুকুরে খাঁচা তৈরি করে মাছ চাষ করে অতিরিক্ত আয় করতে পারব"।
বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, "ভেটকির আঞ্চলিক নাম কোরাল, কেউ বা পাতারি মাছও বলে। এই মাছটি দক্ষিণাঞ্চলে বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন একটি মাছ। বর্তমান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়ের ইচ্ছায় ভেটকি মাছের কেইজ কালচার (খাঁচায় চাষ) প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। আমরা খাঁচায় চাষ করে যদি ভাল একটি প্রযুক্তি স্থানীয় চাষীদের দিতে পারি, তাহলে চাষীরা লাভবান হবে বলে আশা প্রকাশ করছি।"