ভাঙা টিনের ঘর, ভাঙা বেঞ্চ চেয়ার- এটিও সরকারি স্কুল
ভাঙা টিনের ঘর। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল ভাঙাচোড়া কিছু বেঞ্চ ও চেয়ার-টেবিল। ঠাসাঠাসি শ্রেণি কক্ষ। মাটির মেঝে। নিচু মাঠ। এ রকম আরও অনেক দৈন্যদশা নিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে নেত্রকোনার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
জেলার কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়নে অবস্থিত বিদ্যালয়টির নাম কাকুরিয়া-মাছিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের কোনো ছোঁয়াই লাগেনি অজো পাড়াগাঁয়ের এ স্কুলটিতে। অথচ কাকুরিয়া-মাছিমসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ১৭০ জন শিক্ষার্থী এ বিদ্যালয়ে নিয়মিত পড়ালেখা করছে।
জানা গেছে, সিধলী-পাবই সড়কের উত্তরপাশে কাকুরিয়া মাছিম গ্রামে ২০১০ সালে এলাকাবাসীর উদ্যোগে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুলটির দুই কিলোমিটার আশপাশে আর কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। কাকুরিয়া-মাছিম ছাড়াও সিলেল কাকুরিয়া, শ্যামপুর প্রভৃতি গ্রামের শিক্ষার্থীরা এ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে।
প্রথমদিকে এটি ছিল রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০১৪ সালে বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১৭০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। আর শিক্ষক আছেন চারজন। এরমধ্যে একজন ডিপিএড (ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন) প্রশিক্ষণে থাকায় বর্তমানে কর্মরত আছেন তিনজন। প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় ওই পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী শিক্ষক হাবিবুর রহমান। ওই বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকের কোনো পদ আজও সৃষ্টি করা হয়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিধলী-পাবই সড়কের উত্তরপাশে খুবই নিচু জায়গায় একটি ভাঙা টিনের ঘর দিয়ে বিদ্যালয়টি তৈরি। টিনশেড ঘরের চারপাশের বেড়াগুলোও জরাজীর্ণ। মেঝে এখনও মাটির। তার উপর ঠাসাঠাসি করে রাখা মাত্র ২০ জোড়া বেঞ্চ। এগুলো নিয়েই তিনটি শ্রেণিকক্ষ।
শিক্ষকদের বসার চেয়ার-টেবিলগুলোও ভাঙা এবং নড়বড়ে। পাকা মেঝে না থাকায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কোনো কক্ষ এবং শিখন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়নি। পঞ্চম শ্রেণির পাঠদানের আগে ওই কক্ষের বেঞ্চে বসিয়েই প্রাক-প্রাথমিকের পাঠদান করা হয়।
এদিকে, টিনশেড ঘরের মেঝে আর সামনের মাঠের উচ্চতা প্রায় সমান। সামান্য বৃষ্টি হলেই মাঠের পানি এসে ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি খায়। বৃষ্টির সময় চালের ছিদ্র দিয়ে শ্রেণিকক্ষে পানি পড়ে। অফিস কক্ষের কাগজপত্র ভিজে যায়। তখন পাঠদান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর বর্ষার শুরুতেই পাহাড়ি ঢলে মাঠ এবং বিদ্যালয়ের মেঝে সম্পূর্ণ ডুবে যায়। বর্ষাকালে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম অঘোষিতভাবে বন্ধ থাকে।
স্কুলটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান জানান, বর্ষাকালে বিদ্যালয়ের ঘরসহ পুরো মাঠে প্রায় দুই থেকে আড়াই ফুট পর্যন্ত পানি ওঠে। বিদ্যালয়ের মাঠে মাটি ভরাট এবং স্থায়ী পাকা ভবন নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি।
বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোশারফ হোসেন সোহান বলে, বৃষ্টির দিনে মাঠ ডুবে গেলে আমরা খেলাধুলা এবং দৈনিক সমাবেশ করতে পারি না। সারাদিন স্কুল ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হয়। বিদ্যালয়ের সামনের সংযোগ সড়কটিও নিচু। বর্ষাকালে সংযোগ সড়কটিও ডুবে যায়।
একই ক্লাসের ছাত্র শাহীন মিয়া বলে, ‘বৃষ্টির সময় টিনের ছাদ গলিয়ে আমাদের মাথার উপর পানি পড়ে। ঝড় এবং বজ্রপাতের সময় খুব ভয় লাগে।’
বিদ্যালয়টির শুরু থেকে কর্মরত সহকারী শিক্ষিকা লাইলী আক্তার জানান, সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে দুইবার কালবৈশাখী ঝড়ে একমাত্র ঘরটি বিধ্বস্ত হয়েছে। দু’বারই আমরা শিক্ষকরা টাকা দিয়ে তা মেরামত করেছি।
তিনি আরও বলেন, ‘ঝড়ের দিনে অভিভাবকরা শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না। কারণ ঘরটির অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। যে কোনো সময় এটি ভেঙে যেতে পারে। আবার শিক্ষার্থীরা আসলেও আকাশে মেঘ দেখলেই তারা বাড়িতে চলে যেতে যায়।’
জানা গেছে, ঘর-দরজা মেরামতসহ আনুষাঙ্গিক কাজের জন্য বছরে মাত্র ৩০-৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। তা দিয়ে কোনো কিছুই ঠিকমতো করা যায় না। কাকুরিয়া-মাছিম গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও এ বিদ্যালয়ে আজও সংযোগ দেওয়া হয়নি। শহীদ মিনার নেই। টিনশেড টয়লেটটিও তালাবদ্ধ থাকে সবসময়। এটির চাবি থাকে শিক্ষকদের কাছে। একটি ওয়াশ ব্লক নির্মাণ করা দরকার বলেও জানান লাইলী আক্তার।
এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আবদুল বারেক বলেন, ‘বিদ্যালয়টির দুরাবস্থার কারণে এলাকার অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলো তাদের ছেলেমেয়েদের শহরাঞ্চলে স্থানান্তর করে লেখাপড়া করাচ্ছে। আমাদের মতো গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরাই এখানে পড়ালেখা করছে। আমরা বিদ্যালয়টির অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান জানান, ‘বিদ্যালয়টির দৈন্যদশা সম্পর্কে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তারা এ বিষয়ে অবগত আছেন।’
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সারওয়ার জাহান বিদ্যালয়টির দৈন্যদশার কথা স্বীকার করে জানান, কলমাকান্দা উপজেলার মোট ১৭২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রায় ২০টি বিদ্যালয়ে এমন দুরাবস্থা ও অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে।
তিনি আরও জানান, এসব বিদ্যালয়ের দুরাবস্থার কথা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবগত করা হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ওবায়দুল্লাহ জানান, জেলার ৮৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্থায়ী বা পাকা ভবন নেই। এ সংক্রান্ত একটি তালিকা অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) বরাবরে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে (এলজিইডি) প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।