মহামারির নতুন ওয়েভে আবারও ঝুঁকির মুখে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা
গতবছরের কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা সামলে যখন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, তখনই মহামারির দ্বিতীয় ওয়েভ তাদের সেই প্রত্যাশার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।
রেস্টুরেন্ট মালিকরা বলছেন, গতবছরের জুলাই থেকে পুনরায় রেস্টুরেন্টগুলো চালু করার পর থেকে তারা প্রায় ৬০ শতাংশ লোকসান পুষিয়ে নেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে করোনার প্রকোপ ও মৃত্যুর সংখ্যা অধিক হারে বেড়ে যাওয়ায় তাদের ব্যবসার গতি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ কমে গেছে।
গতবছরের করোনা মহামারির ফলে দেশের অন্তত ১০-১৫ শতাংশ রেস্টুরেন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে নতুন করে করোনার প্রকোপ বাড়ায় আবারও বহু রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতি।
চলমান সাত দিনের লকডাউনে রেস্টুরেন্টগুলোতে শুধু অনলাইনে খাবার ডেলিভারি এবং পার্সেল করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সেবা চালু রয়েছে।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত স্টার কাবাব-এর স্বত্বাধিকারী মীর আক্তার উদ্দিন দুলাল বলেন, 'নতুন করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গতমাসে আমাদের মাত্র ৪০-৫০ শতাংশ আয় হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের বিক্রি-বাট্টায় ক্ষতি হয়েছে ৩০-৪০ শতাংশ।'
'আমরা লকডাউনের মধ্যে আমাদের খাবার টেকএওয়ে বা বাসায় নিয়ে যাওয়া সেবা চালু রাখবো। আমাদের ২০০ কর্মীকে ছুটি দেওয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি', বললেন দুলাল।
দুলাল আরও জানান, লকডাউনের প্রথম দিন সোমবারে টেকএওয়ে বা অনলাইন ডেলিভারি সেবার মাধ্যমে তাদের কোনো ব্যবসা হয়নি বললেই চলে।
সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি ইমরান হাসান জানান, দেশজুড়ে তার ২৩ টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে যেগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশেপাশে অবস্থিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় তিনিও রেস্টুরেন্টগুলো চালু করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, 'ফার্মগেট এলাকায় আমার একটি রেস্টুরেন্ট গতবছরের নভেম্বর থেকে স্থায়ীভাবে বন্ধ রয়েছে। অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমাদের ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছে এই সময়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও আর খোলেনি।'
তিনি আরও জানালেন, শুধু টেকএওয়ে সেবা চালু থাকার পরও বিকাল ৪ টা- সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যেই রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পুলিশ তাদের চাপ দিচ্ছে। যদিও এ ব্যাপারে সরকারি কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি, যোগ করেন তিনি।
ধানমন্ডির 'বাবুর্চি' রেস্টুরেন্টের মালিক ও সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক, সৈয়দ মোহাম্মদ আন্দালিব জানান, টেকএওয়ে ও অনলাইন ডেলিভারি সেবায় রেস্টুরেন্ট মালিকদের স্বাভাবিক ব্যবসার ৫ শতাংশও উঠবে না।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে রেস্টুরেন্ট পুনরায় চালুর পর থেকে তার নিজের ব্যবসা ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন জানিয়ে আন্দালিব বলেন, 'আমরা রেস্টুরেন্ট পুনরায় চালু করার পর থেকেই সবরকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছি। কিন্তু বিয়ে, বড় বড় সভা ও র্যালির জন্যই ভাইরাসের সংক্রমণ আবার বেড়ে গেছে।'
তিনি আরও বললেন, 'আমরা সরকারের কাছে সামাজিক দূরত্ব মেনে ধারণ ক্ষমতার ৫০ শতাংশ খালি রেখে রেস্টুরেন্ট খোলা রাখার অনুমতি চাইছি। কিন্তু সরকার আমাদের অনুমতি দেয়নি।'
বিআরওএ'র তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে ৬০ হাজার রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যার মধ্যে ৮ হাজারই ঢাকায় অবস্থিত। বর্তমানে এই খাতে প্রায় ১২ লাখ মানুষ নিয়োজিত রয়েছেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে গতবছরের ২২ মার্চ থেকে সারা দেশের সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর জুনের দিকে সীমিত পরিসরে পুনরায় রেস্টুরেন্টগুলো চালু হয়। কিছু রেস্টুরেন্টে এখনো শুধু টেকএওয়ে সেবা চালু আছে।
করোনার প্রথম ধাক্কায়ই চাকরি হারিয়েছেন হাজার হাজার রেস্টুরেন্টকর্মী। তাই নতুন করে করোনার সেকেন্ড ওয়েভের ফলে আবারও নিজেদের ব্যবসা ও চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত রেস্টুরেন্ট মালিক ও কর্মীরা।
বিআরওএ'র বর্তমান ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম রেজাউল করিম সরকার রবিন বলেন, 'করোনার প্রথম ধাক্কায়ই যে ক্ষতি হয়েছে তা-ই আমরা এখনো পুরোপুরি সামলে উঠতে পারিনি। ১০-১৫ শতাংশ রেস্টুরেন্ট আর চালু করাই সম্ভব হয়নি। ঢাকার মধ্যে দুই শতাধিক রেস্টুরেন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। গুলশান রেস্টুরেন্টের বনানী শাখা আর চালুই হয়নি।'
তিনি জানালেন আশেপাশের কিছু রেস্টুরেন্ট লকডাউনের মধ্যেও খোলা রয়েছে।
বগুড়ার সৈকত হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টেরও স্বত্বাধিকারী এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, 'আমার রেস্টুরেন্টে সাধারণ সময়ের চেয়ে ৫০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে । আমাদের ৫৮ জন কর্মীর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চয়তার মুখে', বলেন রবিন।
মহামারিতে রেস্টুরেন্ট খাতের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় বিআরওএ ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও মিষ্টির দোকানসমূহের সহায়তার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দাবি করেছে। কিন্তু তাদের সেই দাবি পূরণ হয়নি।
রবিনের মতে, যদি করোনার এই নতুন ওয়েভের সময় সহায়তা না দেওয়া হয় তাহলে রেস্টুরেন্ট খাত টিকে থাকতে পারবে না।
গুলশানের ১৩৮ ইস্ট ক্যাফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশফাক রহমান আসিফ জানান, তিনি এখন আসন্ন ইদ ও রমজানের সময় কর্মীদের বেতন কীভাবে দিবেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
'ঢাকায় আমার ৫ টি রেস্টুরেন্ট আছে। যদি এই সংকট চলতে থাকে তাহলে আমার কিছু রেস্টুরেন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিতে হবে,' বলেন আসিফ।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Fresh Covid wave puts restaurant recovery at risk