রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে খুলনার হাসপাতাল, চরম শয্যা ও অক্সিজেনের সংকট
খুলনা অঞ্চলে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় করোনা হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে। ফলে দেখা দিয়েছে চরম শয্যা সংকট। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে অক্সিজেনের সংকট।
রোগীর চাপ সামলাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালিত খুলনা ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালকে ১০০ শয্যা থেকে ১৩০ শয্যায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া, খুলনা জেনারেল হাসপাতালে ৭০ শয্যার করোনা ইউনিট চালু করা হয়েছে। তরপরও, রোগীর চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এ অবস্থায় খুলনা আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে নতুন করে ৪৫ শয্যার করোনা ইউনিট চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, ১৩০ শয্যার ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালকে এখন ২০০ শয্যায় উন্নীত করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে করোনা রোগীদের জন্য বাড়ছে আরও ১১৫ শয্যা।
গত ২৪ ঘণ্টায় খুলনার তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনায় আরও ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত ২৯ জুনের এক পত্রের আলোকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে করোনা ইউনিট চালুর নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনার আলোকে, গত বুধবার সকালে হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে সকল বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই হাসপাতালের উত্তর পাশের জরুরি বিভাগ সংলগ্ন প্লাস্টিক অ্যান্ড বার্ন ইউনিটের ২০টি এবং ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগে ১৫টি বেড স্থাপন কার্যক্রম শুরু হয়। ওই ৩৫টি বেড ছাড়াও চতুর্থ তলার আইসিইউ বিভাগের ১০টি বেডও করোনার রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের করোনা ইউনিটের প্রস্তুতি সম্পর্কে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. এস. এম. মোর্শেদ জানান, শনিবার থেকে এখানে শুধু করোনা পজিটিভ রোগীদেরই ভর্তি করা হবে। যেহেতু আগে থেকেই প্রতিটি বেডের সঙ্গে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন টানা ছিল, সেহেতু এখন সেখানে শুধুমাত্র বেডগুলো বসিয়েই রোগী রাখার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আইসিইউর ১০টিসহ মোট ৪৫টি বেডে রোগী ভর্তি করা হবে।
আপাতত যে জনবল আছে তা দিয়েই করোনা ইউনিটের যাত্রা শুরু হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে আরও কিছু জনবল চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পত্র দেয়া হয়েছে। নতুন প্রস্তাবনায় ২০ জন ডাক্তার, ৫০ জন নার্স এবং ৫০ জন আউটসোর্সিং কর্মচারী চাওয়া হয়েছে।
শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ও করোনা ইউনিটের মুখপাত্র ডা. প্রকাশচন্দ্র দেবনাথ বলেন, শনিবার থেকে যাতে করোনা রোগী ভর্তি করা যায় তার প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, করোনা ইউনিটে শুধুমাত্র পজিটিভ হয়েছে এমন রোগীদের ভর্তি করা হবে। এজন্য ইউনিটটি সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে। নিচ তলা থেকে রোগীদের চতুর্থ তলার আইসিইউতে নেওয়ার জন্যও ব্যবহার করা হবে পৃথক লিফট।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ এবং করোনা প্রতিরোধ ও সমন্বয় কমিটির সদস্য ডা. মেহেদী নেওয়াজ বলেন, গত বৃহস্পতিবার তিনি শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের করোনা ইউনিট পরিদর্শন করে এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর শয্যা সংখ্যা বাড়লে আরো যত্ন সহকারে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় শনিবার থেকে শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ শয্যাসহ মোট ৪৫টি শয্যা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া, ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে আরও ৭০টি শয্যা। এতে করে, রোগীদের আরও ভালোভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে খুলনার হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় অক্সিজেন সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। সূত্রমতে, প্রতিদিন ৭০০ অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা রয়েছে। সেখানে সরবরাহ করা হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪১০টি সিলিন্ডার। ফলে প্রতিদিন ঘাটতি থাকছে ২৯০টি সিলিন্ডার। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছে করোনা রোগী ও তাদের স্বজনরা।
গত বৃহস্পতিবার রাতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) পিসিআর ল্যাবে প্রথম দিন ৬৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। যা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৭২.৫৩ শতাংশ।
সূত্র জানায়, খুবির পিসিআর মেশিনে গত বৃহস্পতিবার ৯১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৬৬ জনের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসে। যার মধ্যে খুলনার ৭৪ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৫৭ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া বাগেরহাটের ৫ জন, যশোরের ২ জন ও সাতক্ষীরার ২ জন রয়েছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তিকৃত যেসব রোগীর করোনা পরীক্ষা না করলে ছাড়পত্র দেওয়া সম্ভব হবে না, তারা নমুনা পরীক্ষায় প্রাধান্য পেয়েছেন। শনিবার (০৩ জুলাই) পর্যন্ত খুমেক ল্যাব জীবাণুমুক্ত করা হবে। ফলে এই তিন দিন নিয়মিত নমুনা পরীক্ষা বন্ধ থাকছে খুমেকের ল্যাবে। খুমেক সূত্র জানায়, করোনা পরীক্ষার ল্যাব বন্ধ থাকায় ২ হাজার নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
অপরদিকে, খুলনার তিনটি হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে খুলনা ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে ৮ জন, খুলনা জেনারেল হাসপাতালে দুইজন এবং বেসরকারি গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
করোনা হাসপাতালের ফোকালপার্সন ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার জানান, খুলনার ১৩০ শয্যা বিশিষ্ট ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে গত ২৪ ঘন্টায় ৮ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২০৪জন; যার মধ্যে রেড জোনে ১১০ জন, ইয়ালো জোনে ৪১ জন, আইসিইউতে ২০ জন ও এইচডিসিতে ২০ জন রয়েছেন। এছাড়া গত ২৪ ঘন্টায় ভর্তি হয়েছেন ২৬ জন ও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৪ জন।
খুলনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের মুখপাত্র ডা. কাজী আবু রাশেদ জানান, খুলনার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ব্যক্তিরা হলেন- খুলনা মহানগরীর হাজী মুহসিন রোডের নীতি রানী দে (৫০) ও ডুমুরিয়া উপজেলার মাধুরী মণ্ডল (৬০)। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালটিতে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ৬ জন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৮ জন। হাসপাতালে সকাল পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন ৬৬ জন।
এছাড়া বেসরকারি গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ব্যক্তি হলেন- যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার নিরঞ্জন পাল। হাসপাতালের স্বত্ত্বাধিকারী ডা. গাজী মিজানুর রহমান জানান, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরো ১০৯ জন। এরমধ্যে আইসিইউতে রয়েছেন ৯ জন ও এইচডিইউতে আছেন ১০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৩৫ জন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৬ জন।