লকডাউনেও চলবে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের কাজ
লকডাউনেও সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প বন্ধ হবে না। যতদূর সম্ভব কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
রোববার ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প মনিটরিং ট্যাক্স ফোর্স কমিটির সভায় এ সিন্ধান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মূখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ যৌথভাবে সভায় সভাপতিত্ব করেন।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ধরে রাখতে কোভিড পরিস্থিতিতেও কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিধি কঠোরভাবে পালন করতে হবে।
তিনি বলেন, লকডাউনে সব ধরণের বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়তো হবে না। তবে সব কাজ করা যেসব কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিন্ধান্ত হয়েছে। যাতে বাস্তবায়ন অগ্রগতি বজায় থাকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দের অর্ধেকেরও বেশি অর্থ ব্যয় হয় অর্থ বছরের শেষের তিন মাস। আর এ সময়ে যদি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে অর্থ ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী করা যায়, তবে বাস্তবায়ন কাজ অনেক পিছিয়ে যাবে। এ কারণে অর্থ বছরের শেষে দিকে করোনা পরিস্থিতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ বেশি বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী কোভিড পরিস্থিতি এবং গত বছরের এপ্রিলে সাধারণ ছুটি ঘোষণার সময় দেশে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পসহ সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বাঁধাগ্রস্ত হয়। সে সময় বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োজিত বিদেশি পরামর্শক ও বিশেষজ্ঞরা প্রকল্প এলাকায় না থাকায় বাস্তবায়ন কাজও গতিহীন হয়ে পড়েছিল।
পরবর্তী সময়ে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজেও গতি কিছুটা বাড়তে থাকে। থাকে। কিন্ত করোনাভাইরাস মহামারির সেকেন্ড ওয়েভে আবারও অবস্থার অবনতি হলে সরকার চলতি মাসের ৫ তারিখ থেকে লকডাউন ঘোষণা করে। একই সঙ্গে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে আরও কঠোর লকডাউনে যাচ্ছে সরকার।
তবে করোনা পরিস্থিতিতেও বাস্তবায়ন কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, কোভিড পরিস্থিতেও সেতুর কাজ অব্যাহত রাখা এবং কার্যক্রম কাঙ্খিত মাত্রায় বৃদ্ধি করা বড় চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে সেতুর কাজে নিয়োজিত দেশী-বিদেশি পরামর্শক এবং চীনা টেকনিশিয়ানদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক রয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় পুরো সেতু প্রকল্প এলাকায় লকডাউন করা হয়েছে।
এছাড়া উন্নত মানের বেড, অক্সিজেন সরবরাহসহ নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং সার্বক্ষণিক চারজন ডাক্তার, নার্স ও সহযোগী কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে সব দেশী এবং অধিকাংশ বিদেশি প্রকৌশলীর প্রকল্প এলাকায় অবস্থানের মাধ্যমে কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
মূল সেতুর ঠিকাদার প্রকল্পে এলাকায় প্রায় ২৫০০ জন শ্রমিকের থাকা-খাওয়াসহ সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরিচালক শফিকুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, করোনা দ্বিতীয় ওয়েভে বাস্তবায়ন কাজ চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকায় লকডাউন করা হয়েছে। তারপরও করোনা পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতুর কাজ ধীরগতিতে চলছে। এখনও ২০ শতাংশ চীনা বিশেষজ্ঞ প্রকল্প এলাকায় নেই। তারপরও আশা করা হচ্ছে অর্থ বছরের পুরো বরদ্দের শতভাগ অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে।
চলতি অর্থবছরে এডিপিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন ধীর গতির কারণে বরাদ্দ কমিয়ে ২০৯৯.৯৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত সংশোধিত এডিপি বরাদ্দের ৬৫.৬৫ শতাংশ বা ১৩৭৮.৬১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে।
মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পে ক্রমপুঞ্জিভুত ভৌত অগ্রগতি ৮৫ শতাংশ । এছাড়া ক্রম পুঞ্জিভুত আর্থিক অগ্রগতি ২৪৮০০.৭৫ কোটি টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৮২ শতাংশ ।
এদিকে করোনা পরিস্থিতিতে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। চলতি অর্থ বছরের বরাদ্দের ৮০ শতাংশ ইতোমধ্যে ব্যয় হয়েছে।
মূল এডিপিতে এ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৩৬৮৫ কোটি টাকা, যা সংশোধিত এডিপিতে বাড়িয়ে ৫৪৫৫ কোটি টাকার করা হয়েছে।
গত মার্চ পযন্ত এ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৪১ শতাংশ । ৩৯২৪৭ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ক্রমপুঞ্জিপূত আর্থিক অগ্রগতি ১৬৮২৬ কোটি টাকা।
বাস্তবায়ন পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প এলাকায় ভূমি অধিগ্রহন এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম এখনও চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়ে গেছে। প্রকল্প সীমানায় রেলওয়ের নিজস্ব বা সরকারি জমি অনেক এখন দখল মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে প্রকল্প কাজ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে । ফলে কোভিড পরিস্থিতি এসব শেষ করার সুপারিশ করেছে আইএমইডি।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার এবং রাশু থেকে মানায়নমার সীমানায় গুনদুম পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প প্রায় ১০ বছর ধরে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতায় আটকে আছে।
আইএমইডি বলছে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ এখনও দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্তরা ঠিকাদারের ভৌত কাজে বাধা দিচ্ছে। এতে প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের গত মার্চ পযন্ত ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৫৪ শতাংশ । চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে এ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১৪৭০ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ৯৯০ কোটি টাকা করা হয়। কিন্ত এ বরাদ্দ মাত্র ৫৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে।
মেট্রো লাইন-৬ প্রকল্পে পরিচালক মো আফতাবউদ্দিন তালুকদার বলেন, আগামী ১৪ তারিখ থেকে যে লকডাউন হচ্ছে, সে সময় প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সাত দিনের কর্মপরিকল্পনা ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সেবা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছ। ১৪ বেডের দুটি হাসপাতাল রয়েছে প্রকল্পের আওতায়। প্রয়োজনে বেডের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।
তিনি বলেন এখন এ প্রকল্পে সাত হাজার জনবল কাজ করছে। সবাই স্বাস্থ্য বিধি মেনে কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির মেট্রোরেল (এমআরটি-৬) প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ৫৫৪৩ কোটি টাকা। এর বরাদ্দের মাত্র ৩৩ শতাংশ বা ১৮৩০.৮০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ নির্মাণ চলতি অর্থ বছরের মার্চ পর্যন্ত সংশোধিত এডিপি বরাদ্দ মাত্র ৫৪.৫৫ শতাংশ বা ৫৫৪৫.৯৮ কোটি টাকা অর্থ ব্যয় হয়েছে এ প্রকল্পে।
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে এ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১৫৬৯১ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন ধীর গতির কারণে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ১০১৬৬.৭৮ কোটি টাকা করা হয়।
প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিভুত অগ্রগতি ৩৩ শতাংশ। ১১৩০৯৩ কোটি টাকার ব্যয় এ প্রকল্পে এখন পযন্ত মোট অর্থ ব্যয় হয়েছে ৩৭২৮৫ কোটি টাকা।
পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে মার্চ পর্যন্ত চলতি এডিপি বরাদ্দের মাত্র ২৩ শতাংশ বা ১১৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
চলতি অর্থ বছরের এডিপিতে এ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৫০৪ কোটি টাকা ছিল। পরে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৬৫১.৬৭ কোটি টাকা করা হয়।
বাস্তবায়ন পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- এ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ কারণে বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখন ৫০ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে ৪২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও ফেব্রুয়ারি পযন্ত ব্যয় মাত্র ৪২ শতাংশ । প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিভুত ভৌত অগ্রগতি ৪০ শতাংশ । ৩৫৯৮৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১৪,৯১০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
১৩২০ মেগাওয়াটে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রকল্পের (রামপাল) প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের ৩১৭২ কোটি টাকার ব্যয়ে লক্ষ্য থাকলেও মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ১১০৫ কোটি টাকা।