লকডাউন: সাধারণ মানুষ মানছেন, মানছেন না
প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে দেশের বিভিন্ন স্থানে লকডাউন দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে বেশিরভাগ এলাকাতেই তা মানছেন না সাধারণ মানুষ। অন্যান্য সময়ের মতোই তারা ঘর থেকে বের হচ্ছেন। যৌথবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টহলে গেলে এক দৃশ্য, আবার তারা সরে গেলে ওই এলাকা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
এবার সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া লকডাউন
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সিলেট জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার বিকেলে জেলা প্রশাসন থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
সিলেটের জেলা প্রশাসক কাজী এম. এমদাদুল ইসলাম বলেন, জেলায় বাইরে থেকে জনসাধারণের প্রবেশ ও প্রস্থান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক-মহাসড়ক ও নৌপথে অন্য কোনো জেলা থেকে কেউ এ জেলায় প্রবেশ করতে কিংবা এ জেলা থেকে অন্য কোনো জেলায় গমন করতে পারবেন না।
এদিকে, শনিবার দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে জেলা করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত জেলা কমিটির বৈঠকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে এ লকডাউন কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কমিটির সভা শেষে জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন সাংবাদিকদের জানান, এ জেলায় জনসাধারণের প্রবেশ এবং প্রস্থান নিষিদ্ধ। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক-মহাসড়ক এবং নৌপথে অন্য কোনো জেলা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রবেশ করতে অথবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে অন্য জেলায় যেতে পারবেন না। তবে লকডাউনের মধ্যে জরুরি পরিসেবা লকডাউনের আওতামুক্ত থাকবে।
নারায়ণগঞ্জে লোকসমাগম ঠেকাতে পুলিশের বিশেষ অভিযান
চতুর্থ দিনের মতো নকডাউন কার্যক্রম চলছে নারায়ণগঞ্জে। নগরীতে লোকসমাগম ঠেকাতে শনিবার সকাল থেকে পুলিশ বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ও নদীপথে বাড়ানো হয়েছে চেকপোস্ট। নারায়ণগঞ্জ থেকে কোনো লোক যাতে আশেপাশের জেলায় যেতে না পারে সেজন্য কঠোর অবস্থান নিয়েছে র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
তবে গত কয়েকদিনের তুলনায় আজ শনিবার নগরীর প্রধান সড়কসহসহ অলিতে-গলিতে লোকসমাগম ছিল খুবই কম। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে যেসব যানবাহন বিনা কারণে ঢোকার চেষ্টা করেছে সেগুলো পুলিশ আটকে রেখে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রেখেছে। যাতে ভবিষ্যতে লকডাউন চলাকালীন সময়ে কেউ বের হতে না পারে।
নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইমতিয়াজ ও মেডিকেল অফিসার জাহিদুল ইসলামসহ নতুন করে আরও আটজনের মধ্যে করোনা ভাইরাস পজিটিভ পাওয়া গেছে। গত ৮ মার্চ থেকে শনিবার পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৮৫ জন। তার মধ্যে মারা গেছেন ১০ জন।
এদিকে, আইইডিসিআর থেকে একটি টিম নারায়ণগঞ্জে এসে করোনা উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত রোগীদের নমুনা সংগ্রহ শুরু করেছেন পরীক্ষার জন্য বিষয়টি জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক) মো. সেলিম রেজা। তিনি আরও জানান, শনিবার বিকেলের মধ্যেই খানপুর ৩শ' শয্যা হাসপাতালে করোনা রোগীর ভর্তি কার্যক্রম ও চিকিৎসা সেবা প্রদান শুরু করা হবে।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম জানান, নারায়ণগঞ্জের লকডাউন কার্যক্রম ও করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত লোকসমাগম ঠেকাতে নারায়ণগঞ্জের সাত জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে সাতটি থানায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে ৭ করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আতঙ্ক
চট্টগ্রামে নভেল করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত ৭ ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার পর নগরজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাসা থেকে বের হচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতির কারণে যৌথবাহিনীর টহল স্বত্বেও এর আগে নগরীতে বিভিন্ন মোডে, গলিতে, বাজারে জটলা দেখা গেলেও এখন সেটি দেখা যাচ্ছে না। ফলে নগরীর সর্বত্র নেমে এসেছে নিরবতা।
চট্টগ্রামে ৭ জনের করোনা পজিটিভ হওয়ার পর লকডাউনে রয়েছে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের বাড়ি। পুলিশের পক্ষ থেকে বসানো হয়েছে পাহারা। কেউ যাতে লকডাউন হওয়া ওই বাড়িতে অবাধে যাতায়াত করতে না পারে সেটি মনিটরিং করছে পুলিশ।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি জানান, করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের অবস্থা স্থিতিশীল। যেসব ব্যক্তিদের শরীরে করোনার লক্ষণ পাওয়া গেছে তাদের বাড়ি প্রশাসনের সহযোগিতায় লকডাউন করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি। সরকারি যেসব নির্দেশনা রয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।
লকডাউন মানছে না টাঙ্গাইলের জনগণ
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে টাঙ্গাইল জেলার সকল প্রবেশের সকল পথে চেকপোস্ট বসিয়ে বন্ধ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। তবে জেলা প্রশাসনের এ ঘোষণাকে কোন আমলে নিচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
টাঙ্গাইল সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার প্রবেশ পথ ও বাজার ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র। এসব স্থানে নানা পরিবহনে অবাধেই যাতায়াত করছেন তারা। শহরের বাজারগুলোতে সাধারণ মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সামাজিক দূরত্ব বজায় না মেনে তারা বাজারে কেনাকাটা করছেন। সরকারি কোনো নিয়ম ও নির্দেশনাকে তোয়াক্কা না করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে যাবতীয় কাজ করছেন সাধারণ মানুষ।
এদিকে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় নিশ্চিত করতে টাঙ্গাইল র্যাবের উদ্যোগে ব্যতিক্রমী বাজার ব্যবস্থাপনা শুরু করেছে। শনিবার সকালে শহরের বটতলা বাজারে টাঙ্গাইল র্যাব- ১২ সিপিসি ৩ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর আবু নাঈম মোহাম্মদ তালাতের উদ্যোগে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তিনি জানান, বাজার করতে আসা সকলকে জীবানুনাশক স্প্রে দিয়ে নিদিষ্ট লাইনে বাজার করতে হবে। বাজার শেষে দুটি বের হওয়ার রাস্তা রয়েছে। সেখানেও জীবাণুনাশক স্প্রে দিয়ে বের হতে হবে।
গাইবান্ধায় ইতিবাচক সাড়া
করোনোভাইরাস বিস্তার রোধে উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গাইবান্ধায় ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে মানুষ। তবে কাঁচা বাজারসহ গ্রামের হাটগুলোতে পরিস্থিতি প্রায় আগের মতোই রয়েছে। প্রশাসন যেভাবে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে তাতে মানুষ সচেতন হচ্ছে।
গাইবান্ধার এসপি মুহাম্মাদ তৈহিদুল ইসলাম বলেন, পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও লকডাউন মেনে চলার জন্য অন্যদের সচেতন করছেন।
তিনি বলেন, অন্য জেলা বা এলাকা থেকে আসা মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রন করতে মহাসড়কসহ গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় পাহারা চৌকি বসানো হয়েছে ৩৬টি। আর এসব চৌকিতে ২৪ ঘণ্টাই কাজ করছেন পুলিশ সদস্যরা।
কুমিল্লায় লকডাউনের মাঝেও জনসমাগম কমেনি
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য শুক্রবার দুপুর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কুমিল্লা জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। তবে লকডাউনের মাঝেও রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি কমেনি। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট যেখানে প্রচারণা
চালান, সেখানে মানুষ কমে। পরবর্তীতে তাদের যাওয়ার পর পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে।
এ বিষয়ে কুমিল্লা ডিএসবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজিম উল আহসান জানান, জনসচেতনতা সৃষ্টিতে এবং লকডাউন নিশ্চিতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন সক্রিয় রয়েছে। কেউ আইন অমান্য করলে ভ্রাম্যমান আদালত প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিবে।
জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর জানান, আমরা সবোর্চ্চ চেষ্টা করছি যাতে মানুষ সচেতন হয়, কিন্ত মানুষ যদি নিজ থেকে সচেতন না হয় তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।
নরসিংদীর মোড়ে মোড়ে অবাধ বিচরণ
নরসিংদীতে লকাডউন মানছেন না সাধারণ মানুষ। লকডাউন উপেক্ষা করে অলিগলি ও সড়কে ভিড় জামাচ্ছে লোকজন। সড়ক মহাসড়কে চলছে রিক্সা, অটোরিক্সা ও প্রাইভেট যানবাহন। নানা অজুহাতে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে হর হামেশাই সাধারণ মানুষ রাস্তা চলে আসছে।
৯ এপ্রিল লকডাউন ঘোষণার পর থেকে নরসিংদীর পৌর শহর থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপজেলাগুলো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শনিবার সকাল থেকেই পাল্টে যেতে থাকে নরসিংদী জেলা শহরের চিত্র।
করোনার ঝুঁকি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন,পুলিশ প্রশাসন ও সেনাবাহীনির একাধিক টিম জেলা বিভিন্ন স্থানে টহল দিচ্ছে। ওই সময় নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনা সদস্যরা হাতে মাইক নিয়ে বিভিন্ন স্থানে সর্বসাধারণকে ঘরে থাকার আহবান জানাতে দেখা গেছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও লকডাউন অমান্য করার কারনে কোথাও কোথাও বেশ কয়েকজনকে আর্থিক জরিমানা এবং মৌখিক মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহ আলম মিয়া।