শিশু শ্রমিক নিয়োগে বাধা ছিল না হাসেম ফুডসের কারখানায়
১৪ বছর বয়সী মেয়ের ছবি নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিলেন মো. সেলিম। রূপগঞ্জের হাসেম ফুডসের কারখানায় যখন আগুন লাগে তখন মেয়ে সেলিনা এর ভেতরেই ছিল। সন্ধান না পেয়ে হাসপাতালে এসে রক্ত দিয়েছেন ডিএনএ পরীক্ষার জন্য।
সেলিম টিবিএসকে বলেন, "রিকশা চালিয়ে যা পেতাম তার সঙ্গে মেয়ের আয় করা ৫৬০০ টাকা অনেক কাজে লাগত। মেয়ে তিন বছর ধরে ওই কারখানায় কাজ করছিল"।
শনিবার রূপগঞ্জে কারখানার সামনে ভাইয়ের মেয়ে মনি আক্তারকে (১২) খুঁজতে এসছিলেন রোজিনা বেগম। আগুন লাগার পর থেকেই তার কোনো খোঁজ পাননি। জানালেন, মাত্র এক মাস আগে সেখানে কাজে ঢুকেছিল মনি।
এছাড়া দুই বছর আগে ১৩ বছর বয়সে কাজে যোগ সে কারখানায় দিয়েছিল লিজা। অন্য ভবনে কাজ করার কারণে আগুনের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান। শনিবার কারখানার সামনে অপেক্ষায় ছিলেন নিখোঁজ পরিচিতজনদের খোঁজে।
সেলিনা, মনি আক্তার, লিজার মতো আরও অনেক শিশুর তথ্য পাওয়া গেছে যারা হাসেম ফুডসের ওই কারখানায় কাজ করত। স্বজনদের অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিচিতজনদের সূত্র ধরে ওই কারখানায় এসব শিশুরা কাজ করত। কারখানায় কাজ করা শিশুর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
কথা বলে জানা গেছে, এসব শিশু শ্রমিক গড়ে ৫ হাজার টাকা বেতন পেত। আর দিনে চার ঘন্টা ওভার টাইমের জন্য পেত ১০০ টাকা প্রতিদিন।
ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে কথা হয় সীমা আক্তারের সঙ্গে। জানালেন ১৪ বছর বয়সী মেয়ে শান্তা মনি এ মাসেই কাজে যোগ দিয়েছেন।
এত ছোট মেয়েকে কেন কাজে দেয়া হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি টিবিএসকে বলেন, "আমি মেয়েকে কাজে দিতে চাইনি কিন্তু ওর সমবয়সী অনেকে ওখানে কাজ করে। তাই মেয়ে বলেছে, মা স্কুল তো বন্ধ, আমি কয়েকমাস কাজ করি"। তিনি ক্ষোভ নিয়ে বলেন, "অল্প টাকায় শিশুদের এ কারখানায় কাজে নেয়া হয়। ডেকে ডেকে কাজ দেয়া হয়"।
হাসেম ফুডস কারখানার ফ্যাক্টরির সামনে শনিবার কথা হয় লিজা, সামিমা ও তানিয়ার সঙ্গে। জুসের টেট্রাপ্যাক বানানোর যে ভবনে তারা কাজ করে সে ভবনে আগুন লাগে নি।
লিজা (১৫) জানান, দুই বছর হয় এখানে কাজ করছেন তিনি। ১৮ বছর বয়সের তানিয়া চার বছর ধরে কাজ করছেন। ১৬ বছরের সামিমা কাজ করছেন নয় মাস ধরে। তাদের সবারই বেতন ৫৩০০ টাকা। তারা টিবিএসকে বলেন, এ কারখানায় শিশুদের কাজে কোনো বাধা নেই।
লিজা বলেন, "কিশোরগঞ্জে আমাদের সবার বাড়ি। অর্থের অভাবে আমরা কাজ করছি"। লিজার দাবি এখানে যারা কাজ করেন তাদের অধিকাংশের বয়স ১৪ বছরের নিচে। এ বিষয় নিয়ে অভিযোগ আসায় অনেক ঝামেলাও হয়েছে বলে জানান তিনি।
কারখানায় শিশু শ্রমিক নিয়োগের বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আবদুস সালাম টিবিএসকে বলেন, "আমাদের লোকজন বিভিন্ন সময়ে কারখানাটি পরিদর্শন করেছেন কিন্তু কী রিপোর্ট দিয়েছে সেটা আমার জানা নেই"৷
সুজন মিয়া মেয়ের সন্ধানের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) এসেছেন। ডিএনএ টেস্টের জন্য দিয়েছেন রক্ত। সুজন মিয়ার মেয়ে ফাতেমা (১৪) কাজ করতো এ কারখানায়।
সুজন মিয়া টিবিএসকে বলেন, 'আমি রিক্সা চালাই। সংসারের খরচ যোগাতে আমার মেয়ে চাকরিতে ঢুকছে। আমার আরেক মেয়েও এখানে চাকরি করে"।
সাত মাস ধরে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানায় নুডলস ম্যাকারনি শাখায় কাজ করেন স্মৃতি (১৩)। তার সঙ্গে কাজ করা অধিকাংশ শ্রমিকই শিশু বলে জানান তিনি। স্মৃতির বাড়ি কিশোরগঞ্জে।
নিখোঁজ আরেক শ্রমিক ১৪ বছর বয়সী ফারজানা। গত তিন বছর ধরে পাঁচ হাজার টাকায় এ কারখানায় কাজ করছিলেন বলে জানান তার মা ঝরনা বেগম। মেয়ের ছবি হাতে নিয়ে তিনি কারখানা এলাকায় ঘোরাফেরা করছিলেন।
জাতীয় শ্রম আইন-২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী, কাজে নিয়োগের সর্বনিম্ন বয়স ১৪ বছর।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ন্যাশনাল প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর সৈয়দা মুনিরা সুলতানা টিবিএসকে বলেন, "আমি জেনেছি এ কারখানায় শিশু শ্রম করায়। এ বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডাইফি) একটি রিপোর্ট দিয়েছে। ১৪ বছর হলে নিয়োগ দেয়া যাবে। এটা বাংলাদেশের আইনেই আছে। তবে দেখা যায়, ১২-১৩ বছরের শিশুদেরও ১৪ বছর বলে কাজে নিয়োগ দেয়া হয়"।