সরকারি সহায়তা নেই, কষ্টে দিন কাটাচ্ছে মহালছড়ির ৪ হাজার জেলে পরিবার
খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার সিলেটিপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হক (৪৯), পেশায় একজন জেলে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশী সময় ধরে কাপ্তাই হ্রদের মহালছড়ি অংশে মাছ আহরণ করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তবে সরকারিভাবে এখনো নিবন্ধিত হতে পারেননি তিনি।
দরিদ্র হলেও সংসার ছোট নয় তার, আট সদস্যের সংসার আব্দুল হকের। স্ত্রী এবং চার কন্যা ছাড়াও প্রয়াত বড় ভাইয়ের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে এই জেলের পরিবারে। বেশ ক'বছর আগে আব্দুল হকের বড় ভাই ও ভাবী অসুখে মারা যান। এরপর থেকেই এতিম ওই দুই শিশুর দায়িত্ব পড়ে আব্দুল হকের কাঁধেই। আটজনের পরিবারে একাই উপার্জনক্ষম আব্দুল হক।
হ্রদে মাছ আহরণ করে সীমিত যা আয় হতো তাতেই কোনরকমে চলত তার টানাটানির সংসার। তবে চলতি মাসের শুরু থেকে হ্রদে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উপোস করে দিন কাটছে এই জেলের।
একই এলাকার আরেক মৎসজীবি ফুলচাঁন মিয়া (৪০)। তবে ইনি সরকারিভাবে নিবন্ধিত একজন জেলে। বয়োজ্যেষ্ঠ অসুস্থ মা ও বাবা, স্ত্রী, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে মিলিয়ে তার পরিবারেও আটজন সদস্য। মাছ ধরা বন্ধ, তাই আয়-রোজগারও নেই এখন। ফলে তিনিও পড়েছেন দুর্বিপাকে। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু'বেলা আহার তুলে দিতে এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে তাকে।
ফুলচাঁন মিয়া বলেন, 'মাছ ধরা বন্ধের সময়ে নিবন্ধিত জেলেদের রেশন হিসেবে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। শুনেছি এবারও ২০ কেজি করেই চাল দেওয়া হবে। তবে এক মাস অতিবাহিত হতে চললেও এখনো রেশন পাইনি আমরা। কখন পাবো তাও ঠিকঠাক জানি না।'
'২০ কেজি চালে আট সদস্যের পরিবার চলে মাত্র এক সপ্তাহ। এরপর আমরা কী খেয়ে বেঁচে থাকি সে খবর কেউই রাখে না। আর শুধুমাত্র চাল দিয়েই কী একটি পরিবার চলতে পারে,' আক্ষেপের সুরে এমন প্রশ্নই ছুঁড়ে দেন জেলে ফুলচাঁন মিয়া।
জেলে আব্দুল হক বলেন, 'যারা সরকারিভাবে নিবন্ধিত জেলে তারা ২০ কেজি হলেও চাল পাবেন। আর আমরা যারা অনিবন্ধিত জেলে আছি তাদের কী অবস্থা তা একবারও ভাবেন না কেউ। অথচ আমরাও নিবন্ধিত জেলেদের মতো সরকারকে নিয়মিতভাবে রাজস্ব দিয়ে আসছি।'
তিনি আরও বলেন, 'একে তো করোনার প্রভাবে আমরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তার উপর একটা ঈদ গত হলো। এমন সংকটময় সময়ে বন্ধ হলো মাছ ধরা, ফলে আয় রোজগারও বন্ধ হয়ে গেল। ঈদের সময়েও আমাদের খোঁজ কেউ নিলো না।'
শুধু আব্দুল হক কিংবা ফুলচাঁন মিয়া নয়, মহালছড়ি উপজেলার এমন জেলে পরিবার অন্তত চার হাজার। এরমধ্যে সরকারিভাবে নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৫শ ৯১ জন। ২০১৪ সালে সরকারিভাবে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয় তাদের। তবে অনেক চেষ্টা তদবিরের পর তারা রেশন পাচ্ছেন কেবল গেল বছর থেকে। তাও নামমাত্র ২০ কেজি চাল, তিন মাসের স্থলে পাচ্ছেন দুই মাস। এছাড়া বাকী আড়াই থেকে তিন হাজার জেলে এখনো অনিবন্ধিতই রয়ে গেছে। ফলে রেশনের এই ২০ কেজি চালও জুটছেনা অনিবন্ধিত জেলেদের ভাগ্যে। এখানকার সকল জেলে পরিবারেই এখন নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। বছরান্তের এই সময়টা কতোটা অনটনে কাটে তাদের, সে খোঁজ নেয়ার যেন কেউই নেই। বংশ পরম্পরায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন এসব জেলেরা। কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরাই এদের একমাত্র পেশা।
কার্পজাতীয় মাছের বংশবিস্তার ও প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিতকরণে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ১লা মে থেকে ৩১শে জুলাই পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। পাশাপাশি মাছ বাজারজাতকরণ এবং পরিবহনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
মহালছড়ি মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি মো. ফরিদ মিয়া বলেন, 'সরকারিভাবে তিন মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে, অথচ রেশন দেয়া হয় মাত্র দু'মাস। তাও কেবল ২০ কেজি করে ৪০ কেজি চাল মাত্র। কেবল এই ৪০ কেজি চালে তিন মাস একটি সংসার চালানো কোনভাবেই সম্ভব নয়। যার দরুন মাছ ধরা বন্ধের সময়কালে পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কাটাতে হয় আমাদের। সরকারের উচিত জেলে পরিবারের দিকে একটু সুনজর দেয়া।'
মহালছড়ি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রবীণ চন্দ্র চাকমা বলেন, 'মাছ ধরা তিন মাস বন্ধ থাকলেও সরকারিভাবে রেশন বরাদ্দ আছে মাত্র দু'মাসের। এবারও দু'মাস ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে নিবন্ধিত জেলেদের।'
এদিকে এই তিন মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ হলেও অভাবের তাড়নায় অনেকটা বাধ্য হয়েই হ্রদ থেকে চুরি করে মাছ ধরে কিছু সংখ্যক জেলে। ফলে মাছের প্রজনন ব্যাহত হয় দারুণভাবে।
ইতিমধ্যে ১লা মে থেকে এ পর্যন্ত দু'দফায় অভিযান চালিয়ে চুরি করে ধরা মাছের দুটি চালান জব্দ করেছে মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশন। সরকারিভাবে জেলেদের পর্যাপ্ত সহায়তা না দেয়া গেলে এই চুরি রোধ করা কোনভাবেই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন জেলে নেতারা।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) মহালছড়ি উপ-কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসরুল্লাহ্ আহমেদ বলেন, 'দারিদ্রতার কারণে অনেকেই চুরি করে মাছ ধরার চেষ্টা করেন। তবে আমরাও সর্তক অবস্থানে রয়েছি। কেউ যেন চুরি করে মাছ ধরতে না পারেন তার জন্য নিয়মিত টহল পরিচালনা করছি। এজন্য সার্বক্ষণিকভাবে সাতজন প্রহরী নিয়োজিত রয়েছে হ্রদের মহালছড়ি অংশে।'
২০২০-২১ অর্থবছরে মহালছড়ির জেলেদের থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৭ লাখ ৬০ হাজার ২শ ৫৪ টাকা। তবে গেল বছর এর পরিমাণ এক কোটি ছাড়িয়েছিল। এবার হ্রদের পানি হ্রাস পাওয়ায় মাছ আহরণ গতবারের তুলনায় অনেকটা কম হয়েছে। ফলে কমে গেছে রাজস্বের হারও। তবে এই রাজস্ব কেবল নিবন্ধিত জেলেদের দেয়া নয়, এতে সমান অংশীদারিত্ব রয়েছে অনিবন্ধিত জেলেদেরও।