সাঈদী চাঁদে: ৭ বছরেও শেষ হয়নি সাক্ষ্য গ্রহণ
দীর্ঘ সময় ধরে বগুড়ায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারকের দু'টি পদ শূন্য থাকার পাশাপাশি নানা কারণে জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে 'চাঁদে দেখার' মামলাগুলোর সাক্ষী এগোচ্ছে না।
''চাঁদে সাঈদীকে দেখা যাচ্ছে'' এমন গুজব ছড়িয়ে ২০১৩ সালের ৩ মার্চ বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডবের ঘটনায় দেড় লাখ জনকে আসামি করে ৫০টি মামলা করা হয়।
পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল মতিন এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, শূন্য থাকা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত (১) এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত (৩) এ দুটি আদালতে মার্চ মাসে বিচারক যোগদান করবেন। দীর্ঘদিন ধরে পদ দু'টি শূন্য রয়েছে।
২০১৩ সালের ৩ মার্চ রাত ২টার পর দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ায় যে, সরকার সাঈদীকে গোপনে ফাঁসি দিয়েছে। এরপর তাকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে। তারা মসজিদের মাইকে এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এমন গুজব ছড়িয়ে ধর্মভীরু জনগণকে ঘর থেকে ডেকে বাইরে আনে। ফজরের নামাজের পর লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে দৃর্বৃত্তরা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রেলওয়ে স্টেশন, থানাসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। জামায়াত শিবির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের তাণ্ডবে ওই দিনের ঘটনায় প্রাণ হারান নারী-শিশুসহ অন্তত ১১ জন।
বগুড়া জেলা পুলিশ এবং আদালত সূত্র জানায়, ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যেই সাক্ষী প্রমাণের অভাবে পাঁচটি মামলার চূড়ান্ত (ফাইনাল) রিপোর্ট দেওয়ার হয়। এ ছাড়া ৪৫টি মামলায় ৮৫৪ জনকে সাক্ষী করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়। ওই ৪৫ মামলায় সন্দিগ্ধ ৮১ হাজার ১৩৬ জন অভিযুক্ত থাকলেও তিন হাজার ১২৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়।
আদালতের একটি সূত্র জানায়, গত সাত বছরে ৮৫৪ জন সাক্ষীর মধ্যে আদালতে মাত্র ৯৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
আবদুল মতিন জানান, বর্তমান জেলা ও দায়রা জজ নরেশ চন্দ্র সরকার এসব মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নিতে বলায় সরকার পক্ষ সাক্ষীদের হাজির করার বিষয়ে কাজ শুরু করেছে।
আদালত ও পুলিশ জানায়, বিচারাধীন ওই মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদ চত্বরে হামলা ও একই সঙ্গে ১৭টি সরকারি অফিস পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। আলোচিত এ মামলাটিতে সন্দিগ্ধ আসামি ছিল ২০ হাজার আর এজাহার নামীয় আসামি ছিল ৩৩০ জন। তদন্ত শেষে ছয় বছরেরও বেশি সময় আগে ২৬৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। ৮৫ জন সাক্ষীর মধ্যে গত সাত বছরে সাক্ষী নেওয়া হয়েছে মাত্র তিন জনের।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নন্দীগ্রাম উপজেলা পরিষদ মসজিদের ইমাম আবদুল জলিল জানান, ঘটনার দিন ফজর নামাজের কিছু আগে লাঠিসহ দেশীয় নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ উপজেলা পরিষদে আসেন। এক পর্যায়ে তারা সরকারি অফিসগুলোতে হামলা চালায়।
''তখন আমি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে, ইসলাম ধর্মের কোনো গ্রন্থের কোথাও মহানবীকে চাঁদে দেখা গেছে এমন কিছু পাইনি। সুতরাং জামায়াত নেতা সাঈদীকে চাঁদে দেখার ঘটনা নিছক গুজব। তারা আমার কথা না শুনে বিভিন্ন অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়।'' বলেন আবদুল জলিল।
তিনি অভিযোগ করেন, "আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে গেলে হামলাকারীরা বালতি ও টিউবওয়েল ভেঙে ফেলে এবং আমাকে মারধর করে।''
একই দিন বগুড়ার শাজাহানপুর থানা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও আওয়ামী লীগ অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার ঘটনায় শাজাহানপুর থানায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়। থানায় হামলাসহ চারটি মামলার সাক্ষী শাজাহানপুরের স্থানীয় ব্যবসায়ী বাদশা আলমগীর।
তিনি বলেন, "আমার চোখের সামনেই নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সের বিপুল সংখ্যক লোজজন দেশীয় অস্ত্র ও জ্বালানি তেল নিয়ে থানা ঘেরাও করে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা ইয়াছিন আলী। তারা থানাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ইট পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে গুলিতে এক পর্যায়ে মারা যায় বেশ কয়েকজন। আমি চারটি মামলায় সাক্ষী হলেও গত সাত বছরে আদালতে সাক্ষী দিয়েছি মাত্র একটি মামলায়।''
বগুড়ার তৎকালীন পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক ফোনে জানান, ওই সময় দুর্বৃত্তরা নয়টি পুলিশ ফাঁড়ি ও চারটি থানাসহ শতাধিক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা করে। "হামলাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল লুটপাট ও প্রশাসনকে অচল করে দেওয়া। তারা বগুড়ায় নিউমার্কেটে কয়েকটি দোকানসহ হামলা করে করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস অফিস ও এসএ পরিবহন অফিসে। দুর্বৃত্তরা পুলিশ সদস্যদের পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করে বগুড়ার ফুলবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির পাশাপাশি শাজাহানপুর থানার পুলিশ সদস্যদের উপর হামলা চালায়।''