সাতক্ষীরার আম যাচ্ছে ইউরোপের চার দেশে
চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলার ৫০০ মেট্রিকটন আম রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। রপ্তানি হওয়ার আমের তালিকায় রয়েছে হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি ও গোবিন্দভোগ। তবে এ বছর গোবিন্দভোগ আম রপ্তানির তালিকায় প্রথম উঠেছে। এ আম যাচ্ছে জার্মানীতে।
মাটি ও আবহাওয়াজনিত কারণে সাতক্ষীরার আম আগে পাকে। স্বাদে, গুণে অনন্য হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই সাতক্ষীরার আম রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। এ বছর গোবিন্দভোগ, ল্যাংড়া, হিমসাগর ও আম্রপালি আম রপ্তানি হচ্ছে ইতালি, জার্মানী, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে। গত ৮ মে (শনিবার) সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কেরেলকাতা ইউনিয়নের পুটুনি এলাকার চাষী দাউদ মোল্লার বাগানের গোবিন্দভোগ আম প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্য দিয়ে বিদেশে আম রপ্তানি কার্যক্রম উদ্বোধন করে কৃষি বিভাগ।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, জেলায় হিমসাগর ১৫৫০ হেক্টর, ল্যাংড়া ৫৬৪ হেক্টর, আম্রপালি ৮৯৯ হেক্টর, গোপালভোগ ২১৯ হেক্টর, গোবিন্দভোগ ৩৫২ হেক্টর, লতা ১৫৩ হেক্টর, বোম্বাই ৫০ হেক্টর, মল্লিকা ৮০ হেক্টর ও ২৩১ হেক্টর জমিতে অন্যান্য আমের চাষ হয়েছে। আমের বাগান রয়েছে ৫২৯৯টি। চাষীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১০০ জন। প্রতি হেক্টর জমিতে এ বছর আমের উৎপাদন হয়েছে ১০-১১ মেট্রিকটন। আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিকটন। জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে সর্বমোট রপ্তানি হচ্ছে ৫০০ মেট্রিক টন আম।
২০১৫ সাল থেকে আম বিদেশে রপ্তানির জন্য চেষ্টা শুরু করে কৃষি বিভাগ। ২০১৬ সাল থেকে সাতক্ষীরার আম প্রথম ইতালীতে রপ্তানি শুরু হয়। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে প্রথম ২৩ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ওই বছরই কিছু আম রপ্তানি হয় ইংল্যান্ড ও জার্মানীতে। রপ্তানি আয় হয় ১৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে রপ্তানি হয় ৩২ মেট্রিক টন। আয় হয় ২৪ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ২৯.৫ টন আম রপ্তানি করে আয় হয় ২১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে দশমিক ৬৯ টন আম ৪৮ হাজার টাকায় রপ্তানি করা হয়। ২০২০ সালে আম্পান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কোন আম রপ্তানি হয়নি। এরপর ২০২১ সালে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ মেট্রিক টন। ইতোমধ্যে গোবিন্দভোগ আম রপ্তানি শুরু হয়েছে জার্মানীতে।
বিদেশে আম রপ্তানির জন্য কাজ করছে দাতা সংস্থা সলিডারিডাডের অর্থায়নে বেসরকারি এনজিও প্রতিষ্ঠাণ উত্তরণ। সফল প্রকল্পের মাধ্যমে বিদেশে আম রপ্তানি করছে প্রতিষ্ঠানটি। দাতা সংস্থা সলিডারিডাডের সফল প্রকল্পের প্রোগ্রাম কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বিদেশে আম রপ্তানির জন্য সাতক্ষীরা জেলার ৩৫০ আম চাষীকে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আম প্রস্তুত ও রপ্তানি করা হয়। এছাড়া যশোর জেলার শার্শা উপজেলার ১৫০ জন চাষী রয়েছে আমাদের প্রকল্পে। গত ৮ মে ২৩৯ কেজি আম জার্মানীতে রপ্তানির মধ্য দিয়ে বিদেশে আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। আমরা ২০০ মেট্রিক টন ল্যাংড়া, হিমসাগর, আম্রপালি ও গোবিন্দভোগ আম রপ্তানির আশা করছি। বিদেশে বেশি রপ্তানি হয় হিমসাগর আমটি।
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, দেশের অন্য জেলার তুলনায় ১৫-২০ দিন আগে সাতক্ষীরার আম পরিপক্ক হয়। সে কারণে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জকে পেছনে ফেলে রপ্তানি বাজারে বেশী গুরুত্ব পায় সাতক্ষীরার ল্যাংড়া, হিমসাগর ও আম্রপালি আম। এ বছর রপ্তানির তালিকায় গোবিন্দভোগের নাম যুক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, বিদেশে রপ্তানি হওয়া আম বাগানগুলোতে আগে থেকে তত্ত্বাবধান শুরু করে কৃষি বিভাগ। যেন কোন চাষী ওই বাগানগুলোতে কীটনাশক প্রয়োগ করতে না পারে। সম্পূর্ণরূপে বিষমুক্ত আম রপ্তানি হয় বিদেশে।
কলারোয়া উপজেলার আমচাষী দাউদ মোল্লা জানান, বিদেশে রপ্তানির জন্য বায়াররা প্রতিমণ আম ২৭০০ টাকা দরে আমাদের থেকে কিনে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করছে। আমাদের দাবি ন্যায্যমূল্য থেকে যেন আমরা বঞ্চিত না হই।
তালার মাঝিয়াড়া গ্রামের আম ব্যবসায়ী গফুর শেখ জানান, আমের ফলন বেশী হলেও এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় আম বেশি বড় হয়নি। মাঝারি আকারের হয়েছে। তাছাড়া এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিও হয়নি। এ বছর লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরা।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন জেলায় আম পাড়ার দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দিয়েছে। পহেলা মে থেকে গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ ও আগামজাতের আম, ২১ মে হিমসাগর, ২৭ মে ল্যাংড়া ও ৪ জুন থেকে আম্রপালি আম পাড়ার তারিখ নির্ধারণ করে প্রশাসন।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, রপ্তানির লক্ষ্যে জেলার কলারোয়া, সাতক্ষীরা সদর, তালা, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলার ৩৫০ জন চাষীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ বছর বাশার অ্যাগ্রো, ইসলাম গ্রুপ, গ্লোব ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, আর আর এন্টারপ্রাইজসহ ১৪টি কোম্পানির মাধ্যমে সাতক্ষীরার আম বিদেশে রপ্তানি হবে। ইতোমধ্যে গোবিন্দভোগ আম জার্মানিতে রপ্তানি কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়েছে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে সাতক্ষীরা থেকে ৫০০ মেট্রিক টন আম ইংল্যান্ড, ইতালী, জার্মানী, ফ্রান্স এ চারটি দেশে রপ্তানি হবে। এছাড়া দেশীয় বাজারে থাকবে ৪০ হাজার মেট্রিক টন আম। ফলন বেশী হওয়ায় এ বছর আমের ৪০ হাজার মেট্রিক টনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস.এম মোস্তফা কামাল বলেন, গাছ থেকে পরিপক্ক আম ভাঙার জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে আম পেড়ে কার্বাইড দিয়ে বাজারজাতকরণের চেষ্টা করলে আম বিনষ্টসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে কালিগঞ্জ ও কলারোয়ায় অভিযান চালিয়ে অপরিপক্ক আম বাজারজাতকালে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। আমের মৌসুমজুড়ে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।