সারি সারি ট্রাক অপেক্ষায়- দিনের পর দিন
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানীতে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথ। গড়ে প্রতিদিন ছোট-বড় মিলিয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার যানবাহন পারাপার হয় এ দুই ঘাট দিয়ে। যার প্রায় অর্ধেকই হচ্ছে পণ্যবাহী ট্রাক।
যাত্রী ভোগান্তির বিষয়টি বিবেচনা করে যাত্রীবাহী বাস, জরুরি পণ্যবাহী ট্রাক এবং ব্যক্তিগত ছোট গাড়িগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারপার করে নৌপথ কর্তৃপক্ষ। এতে দীর্ঘ ভোগান্তির কবলে পড়তে হয় সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক চালকদের।
আধা ঘণ্টার নদীপথ পার হতে ট্রাকচালকদের ফেরিঘাট এলাকায় অপেক্ষা করতে হয় দিনের পর দিন। ঘাট এলাকায় বাড়তি যানবাহনের চাপ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই ভোগান্তি শুরু হয় তাদের। আর এতে করে লোকসানে পড়েন ট্রাক মালিকরা।
তিন বা চার দিন ঘাট এলাকায় আটকে থাকলে কমে আসে গাড়ির আসা-যাওয়ার (ট্রিপ) সংখ্যা। অথচ ট্রাকের চালক ও সহকারীদের নিত্যদিনের খরচ দিতে হয় ঠিকই। গাড়িও বসে থাকে অলস অবস্থায়। যে কারণে অর্থনৈতিকভাবেও বিপাকে পড়তে হয় কিস্তিতে গাড়ি কেনা ট্রাক মালিকদের। প্রতি মাসেই গুনতে হয় লোকসান।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ট্রাক মালিকদের দেওয়া তথ্যমতে, করোনা মহামারি সময়ের শুরু থেকে কমে এসেছে সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাকের ট্রিপ, কমেছে ভাড়াও। কোটি টাকা ব্যয় করেও আসছে না কোনো মুনাফা। এর মধ্যে আবার কিস্তির চাপও রয়েছে। সব মিলিয়ে ট্রাক মালিকদের বেশ লোকসান পোহাতে হচ্ছে, বলে দাবি করেন তারা।
মেহেরপুর জেলার ট্রাক মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, আমার সাতটি ট্রাক রয়েছে। করোনার সময় থেকে সবগুলো ট্রাক অলস বসে আছে।
''এখন একটু ট্রিপ শুরু হলেও ফেরিঘাট এলাকায় ভোগান্তির কারণে, সেখানেই ব্যয় হচ্ছে মুনাফার বড় অংশ। কোটি টাকা ব্যয় করেও লোকসান গুনতে হচ্ছে'', যোগ করেন তিনি।
আগে প্রতিমাসে তার গাড়িগুলো গড়ে ১৮ থেকে ২২টি ট্রিপ পেত। সে হিসেবে গড়ে প্রতি মাসে এক লাখ টাকার উপর লাভ থাকত। কিন্তু করোনাভাইরাস আসার পর যে মন্দা তৈরি হয়েছে- তার সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে ফেরি ঘাটের অপেক্ষা।
''এখন মাসে আমার ট্রাক সর্বোচ্চ সাত থেকে আটটি ট্রিপ পায়। সব খরচ বাদ দিয়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা থাকে। যা দিয়ে কিস্তির টাকাই ওঠে না। সংসার চালাবো কীভাবে!'', প্রশ্ন রাখেন তিনি।
ট্রিপ কমে যাওয়ায় ট্রাক চালকদেরও আয় কমেছে। পাটুরিয়া ফেরিঘাটে অপেক্ষমাণ থাকা আবুল হোসেন নামে এক ট্রাকচালক জানান, প্রতি ট্রিপের নির্ধারিত ভাড়ার ১০ শতাংশ তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে। এটাই তাদের আয়। কিন্তু, ঘাটে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকায় তাদের ট্রিপ যেমন কমেছে, তার সঙ্গেই কমেছে আয়ও।
সাতক্ষীরা এলাকার ট্রাক মালিক শাহীনুর রহমান বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথ। আধ ঘন্টার নৌপথ পারাপারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তিন থেকে চার দিন। কখনও আবার এর চেয়েও বেশি।
''গাড়ি ব্যবসায় এমনিতেই দিন দিন মুনাফা কমে আসছে। বাড়ছে যন্ত্রপাতি ও স্টাফদের খরচ। সেই তুলনায় বাড়ছে না ভাড়া। এরপরে ঘাট এলাকার ভোগান্তি এখন সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয়।'' অচিরেই এই ভোগান্তি লাঘব না হলে ট্রাক মালিকদেরকে এই ব্যবসা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই বলে জানান তিনি।
সাঈদ হোসেন নামে এক ট্রাক চালক জানান, পাটুরিয়া এবং দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় ভোগান্তির শেষ নেই। সারা রাস্তায় গাড়ির চালানোর চেয়েও দ্বিগুন ভোগান্তি ঘাট এলাকায়। প্রায়ই আমাদের তিন থেকে চার দিন ঘাটে পড়ে থাকতে হয়। তবে বাড়তি টাকা দিলে পাটুরিয়া ঘাটে পারাপারে কিছুটা ভোগান্তি কমে, বলে জানান তিনি।
তবে ফেরিঘাট এলাকায় যানবাহনের চাপ অনুযায়ী বড় ফেরির সংখ্যা বাড়ানো এবং চলমান পদ্মাসেতুর কাজ শেষে দ্রুত উদ্বোধনের দাবি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ট্রাক মালিকদের।
বিআইডব্লিউটিসি'র আরিচা কার্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন রাসেল বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ছোট বড় মিলে ১৬টি ফেরি রয়েছে। যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে মেরামতে রয়েছে চারটি ফেরি। বাকী ১২টি দিয়ে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। এ কারণে ঘাটে জটের সৃষ্টি হয়।
পাটুরিয়া ফেরিঘাট মেরামত কারখানা মধুমতির নির্বাহী প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান নামে বড় ফেরিটি গত এপ্রিল থেকে ইঞ্জিনের ত্রুটি নিয়ে মেরামত কারখানায় রয়েছে। আরেক বড় ফেরি শাহজালাল পাঠানো হয়েছে নারায়ণগঞ্জের মেরামত কারখানায়।
এছাড়াও, তীব্র স্রোতের কারণে চলাচল করতে না পেরে সন্ধ্যা-মালতি ও মাধবিলতা নামের ছোট দুইটি ফেরি মেরামত কারখানায় বসে আছে। স্রোত কমলে নদীতে চলাচল শুরু করবে ফেরি দুইটি। আর বড় ফেরি দুইটি মেরামতে দীর্ঘ সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
বিআইডব্লিউটিসি'র আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম জিল্লুর রহমান বলেন, নদীতে তীব্র স্রোত আর ফেরি সংকটের কারণে ভোগান্তি বাড়ছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথের উভয় ফেরিঘাট এলাকায়।
যাত্রী ভোগান্তির বিষয়টি বিবেচনা করে জরুরী পণ্যবাহী ট্রাক, বাস ও ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি নৌপথ পারাপার করা হচ্ছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। যে কারণে দীর্ঘ সময়ের ভোগান্তির কবলে পড়েন সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক চালকেরা।
সোমবার (২৭ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথের উভয় ফেরিঘাট এলাকা মিলে এক হাজারের বেশি যানবাহন অপেক্ষমাণ ছিল। এর মধ্যে সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যাই আট শতাধিক। বিকেল নাগাদ বাসের চাপ শেষ হলেও, ট্রাক পারাপার শেষের বিষয়ে কিছু বলতে পারেনি ডিজিএম জিল্লুর রহমান।