সিনহা হত্যা মামলা: পঞ্চম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু
টেকনাফের মেরিন ড্রাইভের বাহারছরা শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকার্যের ৬ষ্ঠ দিনে পঞ্চম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় দফার টানা চারদিনের ৩য় দিনে ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী হাফেজ মো. আমিনের জবানবন্দি গ্রহণের মাধ্যমে মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) ১০টা ৫ মিনিটে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।
পিপি ফরিদ বলেন, হাফেজ মো. আমিনের সাক্ষ্যের গুরুত্ব অত্যধিক। কারণ হাফেজ মো. আমিন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তাই সিনহার সফরসঙ্গী সিফাতের মতো হাফেজ আমিনের জবানবন্দি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পিপি আরো বলেন, আদালতের কার্যক্রম শুরুর সাথে সাথে আসামী প্রদীপ কুমার দাশের আইনজীবী রানা দাশ গুপ্ত আদালতের কাছে নিবেদন করেন যে, তার মক্কেল সরকারী নিয়মনীতির আলোকে একজন ১ম শ্রেণীর অফিসার হিসেবে কারাগারে যে সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখেন, তা থেকে প্রদীপ কুমার বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই কারাবিধি অনুসারে ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতের দাবি জানান। আদালত কারাবিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশনামা প্রেরণ করা হবে বলে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে, আসামী পক্ষের অপর আইনজীবী, ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন তা তলবের আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করে দেন। প্রয়োজন অনুসারে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তা উপস্থাপন করার কথা বললে পিপি তার বিরোধিতা করে বলেন এটি একটি রাষ্ট্রীয় নথি, এটি এই মামলায় এই মুহুর্তে উপস্থাপন করার প্রয়োজন নেই। পরে আদালত সাক্ষী হাফেজ মো. আমিনের জবানবন্দি রেকর্ড করা শুরু করেন বলে বিচারকার্যে সংশ্লিষ্ট একাধিক আইনজীবী জানান।
আদালতের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী বাপ্পী শর্মা জানান, অন্য দিনের মতো সকাল পৌনে ১০টার দিকে মামলার আসামী সাবেক ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ১৫ আসামীকে কারাগার হতে আদালতে আনা হয়। দ্বিতীয় দফার ৩য় দিনের জন্য হাফেজ মো. আমিন, শওকত আলী ও সাইফুল আবছার আবুইয়ার সাক্ষ্যের হাজিরা দেয়া হয়। প্রথম দিন ৬ জনের এবং দ্বিতীয় দিনে ৩ জনের হাজিরা দেয়া হলেও মাত্র একজন করেই সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এরপরও দ্রুততায় সম্পন্ন হবার আশায় আজকেও তিনজনের হাজিরা দেয়া হয়েছে।
পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদ বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা থাকে হাজির সবার সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন করার। তবে, আসামি পক্ষের আইনজীবীগণের অসহযোগিতায় সেটা সম্ভব হয়না। তারা সাক্ষীকে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করেন। আর ১৫ আসামীর ১৫ আইনজীবী আলাদাভাবে আধাঘন্টা করে জেরার সময় নিয়ে সাড়ে সাতঘন্টা সময় লাগে। জবানবন্দি নিতেও সময় লাগে ঘন্টা দেড়েক। এতে আদালতের কর্মঘন্টা ৯ ঘন্টা এবং মধ্যহ্ন বিরতিসহ দাঁড়ায় ১০ ঘন্টা। ফলে, একজনের বেশি সাক্ষ্যে আগানো সম্ভব হয়ে উঠছে না।
আদালতের সূত্র জানায়, গত ২৩ আগস্ট শুরু হয় মেজর সিনহা হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম। সাক্ষ্যগ্রহণে আদালতের নির্ধারণ করা প্রথম তিনদিনের প্রথম দিন পুরো ও দ্বিতীয় দিনের অর্ধেক সময় মামলার বাদী নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন ফেরদৌসের সাক্ষ্য ও জেরা হয়। পরে শুরু হয় সিনহার সফরসঙ্গী ও হত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী সিফাতের সাক্ষ্য। এ দুজনের সাক্ষ্য ও জেরার মধ্য দিয়ে শেষ হয় বিচারকার্যের প্রথম নির্ধারিত তিন দিন। ফলে এ তিনদিনের জন্য নোটিশ পাওয়া ১৫ সাক্ষীর মাঝে বাকি ১৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া সম্ভব হয়নি। ২৫ আগস্ট আদালত ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর টানা চারদিন পরবর্তী সাক্ষ্যের জন্য দিন ধার্য্য করেন। সেই মতে রবিবার (৫ সেপ্টেম্বর) সকাল সোয়া ১০টার দিকে বাকি সাক্ষীদের একজনের সাক্ষ্য শুরু হয়ে সারাদিন তাকেই জেরায় দিন শেষ হয়। দ্বিতীয় দিনও একইভাবে একজন সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা হয়েছে। মামলায় মোট সাক্ষী ৮৩ জন। সাক্ষ্য ও জেরার সময় ১৫ আসামি কাঠগড়ায় উপস্থিত রয়েছে। পুরো জেলা জজ আদালত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করে। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান।
সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। ঘটনার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম।
অভিযুক্ত আসামিদের মাঝে পুলিশের ৯ সদস্যরা হলেন, বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেবল রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া ও কনস্টেবল সাগর দেব নাথ।
অপর আসামিরা হলেন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আব্দুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিষবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের করা মামলার সাক্ষী নুুরল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
কারান্তরীণ আসামিদের ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে ওসি প্রদীপ, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেব আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এর আগে আসামিদের তিন দফায় ১২ থেকে ১৫ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল।