‘আমি কোনো মেজর ( অবঃ) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পিএসসিকে চিনতাম না’
১.
আমি কোনো মেজর সিনহাকে চিনতাম না।
আমি, আমার বন্ধু সিনহাকে চিনতাম। বেশ ভালো চিনতাম একজন মানুষ হিসেবে।
যে সিনহা আমার সাথে প্রথম দেখাতেই উইল ড্যুরান্টের 'দ্য স্টোরি অফ ফিলোসফি' ধার নিয়েছিল পড়ার জন্য, পরে ফেরত দিয়েছিল যত্ন করে।
যে সিনহা আমার সাথে ১০টা কথা বললেই, ৮টা কথা ভ্রমণ বা জীবনের ফূর্তিময় রোদেলা দিক নিয়ে হতো।
যে সিনহা জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারের কথা শুনলে বেশ অভিমান এবং ক্রোধ ভরেই বলত যে, উন্নত দেশের নানা সুবিধা, ট্রেনিং, ব্যাকঅ্যাপ ইত্যাদির সাহায্যেও অনেকেই নায়ক হয়ে আছে ইতিহাসে, সেখানে আমাদের মত 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' এর সামাজিক আবহে ব্যাপক প্রতিভা এবং পরিশ্রমের পরেও আমরা অনেকেই একটা নির্দিষ্ট জায়গার পরে আর এগোতে পারি না, ডগলাস ম্যাকআর্থার আমাদের হওয়া হয় না।
কিন্তু আবার আমরা আলবেয়ার ক্যামুর জীবনের সংজ্ঞা মতে যে আত্মহত্যা না করে বেঁচে আছি, সুস্থ থাকবার চেষ্টা করে যাচ্ছি নিরন্তর- সেটা মনে করিয়ে দিলেও সাথে সাথে একমত হতো।
যে সিনহা মানব জাতির সব হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা নিয়ে জারর্ড ডায়মন্ডের 'দ্য কলাপস' পড়ে ঠিক কী কারণে মানুষের ইতিহাস একই ধরনের ভুলে ভরা সেই নিয়ে আড্ডা দিত।
চরম ফুর্তিবাজ সিনহা রাজশাহী থেকে ঢাকায় বাড়ি যাবার আগে আগে করোনা টেস্ট করতে দিয়েছিল মেডিকেলে। আমি খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন করছেন করোনা টেস্ট? সে সাথে সাথে বলল, কারণ বাড়ি যাচ্ছি ক'দিনের জন্য, মা বয়স্ক মানুষ, তাই কোনরকম ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। জানি করোনা হয়নি, তারপরেও নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে ফুরফুরে মনে মায়ের কাছে গেলাম।
সবসময়ই ড্যাম কেয়ার বন্ধুটার ভিতরে চরম দায়িত্বশীল আরেক মানুষকে আবিষ্কার করলাম নতুন করে।
সিনহা যে অনেকের কাছেই চরম আকাঙ্ক্ষিত স্টাফ কলেজের ডিগ্রি পাস করেছিল জানতাম না, তাঁর বাড়িতে নামফলকে লেখা দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে ঘাড় নাড়িয়ে শ্রাগ করে উত্তর দিয়েছিল, 'ঐ করে ছিলাম আর কী'।
সিনহাদের জুনিয়র এক মেজর বন্ধু ঢাকার এক আড্ডায় আমাকে অবাক হয়ে বলেছিল,'আপনি সিনহা স্যারের বন্ধু! আপনি কি জানেন যে, স্যার সারা সেনাবাহিনীতে একজন লিজেন্ড?" আমি বললাম না, কেন লিজেন্ড? সেই মেজর উত্তর দিয়েছিল, ' সিনহা স্যার অসম্ভব যুক্তি দিয়ে যে কোন বিষয়ে মানুষের মতামতকে নিজের পক্ষে টেনে আনতে পারে, সে চাইলে এক ঘর মানুষকে ৫ মিনিটে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিবে যে পৃথিবী আসলে সমতল, গোল না। পরে হয়তো এই ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দিবে ফের মজা করে'।
এই কথার প্রমাণ পেয়েছিলাম আরেক মেজর বন্ধুর কথায়, সে জানিয়েছিল সিনহা যখন অবসর নিতে চায় এবং অফিসিয়ালি নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগোতে থাকে, স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনীর অন্যতম চৌকস অফিসার এবং এসএসএফের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অফিসারটিকে নানা ভাবে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল সামরিক বাহিনীতে। এক ইন্টারভিউ বোর্ডে একজন মেজর জেনারেল, একজন বিগ্রেডিয়ার ও কর্নেল তাকে নানা ব্যাপারে প্রশ্ন করছিলেন। তারা বলেছিলেন, সিনহার এত ব্রাইট ক্যারিয়ার, সে কেন মাঝ পথে এত কম বয়সে এই সোনার হরিণ চাকরি ছেড়ে দিবে? তাঁর ভবিষ্যৎ তো অতি উজ্জল। তাদের উত্তরে সিনহা যে কথাগুলো বলেছিল, যুক্তিগুলো দিয়েছিল, তা শুনে শুনেছি মেজর জেনারেল নিজেই ব্রিগেডিয়ারকে বলেছিলেন, 'ছেলেটা তো ভুল কিছু বলছে না, ঠিকই তো, আমরাই বা অবসর নিয়ে ফেলছি না কেন?"
আবার সিনহা আমাকে এও বলতো, দেশে কোনোদিন যুদ্ধ লাগলে, তেমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সে অবশ্যই ফের দেশের সেবায় নেমে যাবে।
কিন্তু তাঁর মেজর পরিচয় নিয়ে, নানান দেশের ট্রেনিং নিয়ে আমরা কোনদিন কথা বলিনি, সেই মেজরকে আমি চিনতাম না।
২.
আমি যাকে চিনতাম, ৩৬ বছরের রাশেদ খান (সিনহা), যে ২০১৮ সালে সব রীতিনীতি মেনে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছিলেন, তখন মাত্র ৩৪ বছর বয়স তার!
অথচ কে না জানে! বাঙালির জীবনের একটাই লক্ষ্য, একটাই মোক্ষ, একটাই উদ্দেশ্য, সেটা হচ্ছে চাকরি! তাও আবার সরকারি উর্দি পড়া চাকরি, তাও আবার ঝকঝকে ক্যারিয়ারে অতি অল্প সময়ে তরতর করে প্রোমোশন পেয়ে, অনেক ট্রেনিং-এ সেনাবাহিনীর সেরাদের তালিকায় স্থান পাওয়া লোক কেন চাকরি ছেড়ে দিবে?
কেন ? কেন ? কেন?
কারণ আমার বন্ধু সিনহা চেয়েছিলেন জীবনের রূপ, রস, গন্ধ কিছুটা নিজের মত করে উপভোগ করতে। চাকরি, পরিবার, সমাজ এই সকল বাধার বাইরেও নিজের প্রজ্ঞা ও জ্ঞানে বুঝতে পেরেছিলেন, জীবন এ সবের বাইরেও অনেক বিশাল ও মহান। সেই বিশালত্বের কিছুটা ছোঁয়ার পাগলামি পেয়ে বসেছিল তাকে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে, সেনাবাহিনীর নিশ্চিন্ত ক্যারিয়ার ছেড়ে দিলেন, মূলত বিশ্ব ভ্রমণের জন্য, নিজের মত জীবনটা দেখার জন্য।
সিনহা বিয়ে করেননি, সংসার গড়ার কোনো পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। কারণ তিনি নিজের মত, সত্যজিৎ রায়ের আগন্তকের মতই সারা ভুবন দেখে এক তুচ্ছ জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই লক্ষ্যে নিজেকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে প্রস্তত করেছিলেন অনেক বছর ধরে। এমন ঠাণ্ডা মাথার সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার স্বপ্নবাজ লোক অবশ্যই আমাদের পছন্দ হবার কথা না।
কথা হলো, এরা কেন এমন স্বপ্ন দেখবে? আবার সেই স্বপ্নকে বাস্তবেও পরিণত করবে?
সিনহার সবচেয়ে বড় দোষ হলো উনি ছিলেন- স্বপ্নবাজ, স্বাধীনচেতা।
এই তো, একবার আমরা নওগাঁ জেলের ধীবর দীঘি দেখতে গিয়েছিলাম, বাঙালির প্রথম স্বার্থক বিদ্রোহের প্রতীক স্তম্ভ দেখতে, যা দীঘির মাঝখানের অবস্থিত। এখানে আমি অনেক বার গিয়েছি, ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী যেকোনো বন্ধুকে নিয়ে আরও অনেক বার যাব। গিয়েই নৌকা নিয়ে দীঘির মাঝের সেই হাজার বছরের পুরনো স্তম্ভ ছুঁয়েও আসি। কিন্তু সিনহাকেই দেখলাম প্রথমজন, যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে শর্টস পরে সোজা দিঘিতে ঝাঁপিয়ে পরে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডোর মত একটানা সাঁতরে যেয়ে স্তম্ভকে ছুঁয়ে ফের ফিরে আসল। এই দৃশ্য দেখার জন্য সেদিন দীঘির চারপাশে ভিড় জমে গিয়েছিল।
যে অবসরের কথা বললাম, সিনহা আমাকে বা কাউকেই কোনোদিন বলেননি যে উনি একজন মেজর, বা অবসর নিয়েছেন সেনাবাহিনী থেকে। সবসময়ই বলতেন,'আমি একজন ফূর্তিবাজ মানুষ, জীবনে শুধু ফূর্তি করি'।
ভীষণ পড়ুয়া ছিলেন, নানান বিষয়ের কঠিন–সহজ সব ধরনের বই পড়তেন দিনরাত। সিনহার সাথে যখন শেষ দেখা হয়, সেদিন সে আমাদের লাইব্রেরি থেকে শেষবার ধার নেওয়া বইগুলো ফেরত দিতে এসেছিল। যে ৩/৪ মাস সে রাজশাহী ছিল, এমন বেশ কবার গাড়ি ভরে বই নিয়ে যেত পড়ার জন্য, এবং যত্ন করে ফেরতও দিত।
ভীষণ ফিটনেস ফ্রিক ছিল, দিনে একাধিকবার জিম করত, সাঁতরাতো, সবসময়ই সিক্স প্যাকের অধিকারী ছিল। কমান্ডো ট্রেনিং প্রাপ্ত একজন দুর্ধর্ষ মার্কসম্যানের মতই তাঁর লাইসেন্স করা রিভলভার নিজের দেহের একটা অংশের মতই বহন করতেন সবসময়ই, সকলের অগোচরে। কোনোদিন সেটা নিয়ে শোঅফ বা ছেলেমি করতে দেখি নাই। তিনি অস্ত্রের গুরুত্ব জানতেন, সেটাকে সন্মানও করতেন।
এসএসএফ ( স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সে) ছিলেন বেশ ক'বছর। এসএসএফ- এর সর্বকালের সেরা অফিসারদের মধ্যে একজন গণ্য করা হয় তাকে। সুনামের সাথেই মনে দাগ কেটেছেন সবার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও।
সেনাবাহিনীতে এডিসি, ব্রিগেড মেজরের মত প্রেস্টিজিয়াস পদে চাকরি করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। মানবিক গুণাবলী আর নিঃস্বার্থভাবে সবাইকে সাহায্য করার মানসিকতার কারণে সৈনিক ও অফিসারদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। রিফ্লেক্স, ফিটনেস, ফায়ারিং সবকিছু মিলে ছিলেন সেরাদের সেরা।
কঠোর নিয়মকানুন যেমন মানতেন তেমন তাঁর নামে এক পয়সার দুর্নীতির অভিযোগও নেই(লাশের সাথে অবশ্য ইয়াবার প্যাকেট পাওয়া যাচ্ছে, যেটা আকছারই যাচ্ছে ইদানীং, যে কেউ মারা গেলেই)।
সবার সাথে মিশে যেতে পারত সহজে। বর্তমান সেনাবাহিনীতে ব্যাচমেট, জুনিয়র এমনকি সিনিয়রদের মাঝে তাঁর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার কথা, অনেকের মনে আইকন হয়ে ওঠার কথা তাঁর সহকর্মীরা বলুক, আমি বলব আশেপাশের নানা পেশার, নানা মানুষের সাথে কী অবলীলায় মিশে যেত পারত সে- সেই কথা। সেই কবে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে ছিল, অথচ বর্ণালীর মোড়ে মালাই চা খেতে গেলেই দোকানি একগাল হেঁসে বলত, 'মামা, বহু দিন পর আইলেন। আমার নানী আজকেও দুইবার জিজ্ঞাসা করলেন যে সিনহা কী আসলেই আর নেই, যে ছেলেটা তাকে প্রায়ই গাড়ি করে ডাব দিয়ে যেত।'
আমি তার সঙ্গে শেষ ছবিটা দেখি। লোনা জল বাঁধ ভেঙে বুকের সমস্ত কষ্ট উথলে বেরিয়ে আসে- আমার বন্ধু বিছানায় শুয়ে আছে, প্রাণহীন। আর কোনোদিন সেই হাসি দিয়ে উঠে বসবে না। গত চার মাস ধরে কত কত ঘণ্টা এভারেস্ট বেজক্যাম্পে হাইকিঙের প্ল্যান, ল্যাতিন আমেরিকা যাবার প্ল্যান, ইউরোপের সব দেশের প্রায় সব শহর নিয়ে বলা কথাগুলো কাজে লাগলো না বন্ধুটার, সে শুয়েই রইল।
কেন শুয়ে রইল? কেন পুলিশের বুলেট তাঁর মত উচ্ছল, সদালাপী যুবকের হৃৎপিণ্ড থামিয়ে দিল? কী বিচার হবে? যাইই হোক, এমন একজন মানুষের জীবনকে অপচয় করার জন্য যেকোন শাস্তিই যথেষ্ট নয়।
বনানীতে সমাহিত করা হয়েছে ডানপিটে স্বপ্নবাজ মানুষটাকে।
সবচেয়ে বড় দোষ সিনহা কেন স্বপ্ন দেখেছিল?
কেন সে সবার মত আটপৌরে জীবনযাপন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না?
সবার শেষে গাঢ় আঁধারের মত ঘোরে ডুবে যেতে যেতে এইটুকুই বিড়বিড় করি বার বার, 'আই মিস মাই ফ্রেন্ড'।
- লেখক: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক্সপ্লোরার কন্ট্রিবিউটার