সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, উত্তরাঞ্চলের ৭ জেলায় পানি বৃদ্ধি
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খুলে জরুরি ত্রাণ বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা শহরের অন্তত তিন শতাধিক বাসা বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। বন্যার্তদের স্থানীয় আশ্রয় কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে প্রশাসন।
অন্যদিকে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টির পানিতে নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা উপজেলা সদরসহ আটটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে বেশকিছু গ্রামীণ সড়ক। উদ্বাখালি, মঙ্গলেশ্বরী ও গণেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে।
এ ছাড়া ভারতে অতিবৃষ্টির কারণে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে উত্তরাঞ্চলের সাত জেলার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে, সাত সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে বগুড়ার যমুনার পানি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট:
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, রোববার সকাল ৯টা থেকে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ২১৩ মিলিমিটার। তাছাড়া পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় ভাটির জনপদ হাওরাঞ্চলে পানির চাপ আরও বাড়ছে।
পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন সড়ক প্লাবিত হয়েছে। জেলা শহরের কাজীর পয়েন্ট, ষোলঘর, সাহেববাড়ি, পশ্চিম বাজার, মধ্যবাজার, তেঘরিয়া, উকিলপাড়া, আরপিননগর, জামাইপাড়া, বড়পাড়া, মল্লিকপুর, নতুনপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। শহরের ড্রেনেজে ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায় শহরের পানিও সরছে না। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে।
পৌর শহরের সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। এ ছাড়াও অন্যান্য উপজেলায়ও আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, রোববার বিকেল ৩টা পর্যন্ত জেলার ১৬৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে এক হাজার ১৪৩ জন বন্যার্ত লোক আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রও প্রস্তুত রয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ বলেন, বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পানি বাড়ছে। পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
'আমরা জরুরি সভা করে ৪১০ টন চাল ও ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
উত্তরাঞ্চলের ৭ জেলায় পানি বৃদ্ধি
কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে এসব তথ্য দেওয়া হয়। উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু জেলায় এখন পানিবন্দি হয়ে পড়ছে কয়েক হাজার মানুষ; ভেসে গেছে ঘরবাড়ি ও জমির ফসল।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, যমুনা নদীর সারিয়াকান্দি পয়েন্টে সাত সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে কুড়িগ্রামে ধরলা, দুধকুমার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোডের্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে রোববার দুপুর ৩টায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সদর উপজেলার ধরলা ব্রিজ পয়েন্টে ধরলার পানি ২৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৭১ সেন্টিমিটার ওপর এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে দুধকুমারের পানি ৩২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়া চিলমারী উপজেলার চিলমারী ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপূত্রের পানি ৩০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ৯টি উপজেলার ৪৭টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত। বন্যায় প্রায় ৬০০ মিটার বাঁধ ভেঙে গেছে এবং এক হাজার ৬৯৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা প্রশাসন থেকে ৯ উপজেলায় ৩০২.৭২ টন চাল এবং নগদ ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
উত্তরাঞ্চলে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া ও দিনাজপুরে আগামী দুই সপ্তাহ বন্যার পানি বাড়তে পারে। তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অন্তত পাঁচটি নদীর পানি পাশের জেলাগুলোয় ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, পদ্মা, আত্রাই ও হাওর এলাকার নদীগুলোর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, ব্রহ্মপুত্রের পানি কুড়িগ্রাম দিয়ে এবং তিস্তার পানি লালমনিরহাটে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। উজানের পানি ছাড়াও দুই সপ্তাহ ধরে উত্তরাঞ্চলে যে টানা বৃষ্টি হচ্ছে, তা দিনাজপুর থেকে নিচের দিকে পড়ছে।
ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জি, আসাম, মেঘালয়সহ হিমালয়ের পাদদেশে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। সেসব পানি দ্রুত বাংলাদেশের দিকে নেমে আসে। দেশের ভেতরও বৃষ্টি বেড়েছে। এ কারণে পানি দ্রুত বাড়ছে।
আগামী এক সপ্তাহ ভারতের এসব রাজ্যে ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর ১০২টি পয়েন্টের মধ্যে ৭৮টির পানি বাড়ছে। সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানি। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদ্মার পানিও বিপৎসীমা অতিক্রম করে যেতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, তিস্তাপাড়ের মানুষকে নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে। এদিকে ভারী বর্ষণ অন্যদিকে উজানের ঢলে তিস্তা নদীতে সৃষ্ট বন্যায় ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানি, ঝুনাগাছ চাঁপানি, গয়াবাড়ি এবং জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি চরের পাঁচ হাজার পরিবারে ২০ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে।
নেত্রকোনায় পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত
গত তিনদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে জেলার কমলাকান্দা উপজেলার প্রধান চারটি নদীই উপচে পড়েছে। উব্দাখালি নদীর পানি উপচে রোববার সকাল নাগাদ কলমাকান্দা উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরসহ উপজেলা সদরের পূর্ববাজার, চানপুর রোড, শিবমন্দির রোড, স্টেডিয়াম রোড, মুক্তিরনগর, থানা রোড ও মন্তলা এলাকার বহু বাসাবাড়িতে পানি ঢুকেছে। উপজেলা পরিষদের প্রায় সবগুলো সরকারি অফিস পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এদিকে উপজেলার আটটি ইউনিয়নের প্রায় সব ক'টিই কম-বেশি প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্লাবিত ইউনিয়নগুলো হচ্ছে-- বড়খাপন, খারনৈ, সদর ও রংছাতি।
বড়খাপন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাদিছুজ্জামান তালুকদার জানান, ওই ইউনিয়নের ২৮ গ্রামের সব ক'টিই প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে গুতুরা-যাত্রাবাড়ি, বড়খাপন-কেশবপুর, উদয়পুর-যাত্রাবাড়ি, রিকা-বড়ইউন্দ ও চৌহাট্টা-কেশবপুর সড়ক।
খারনৈ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওবায়দুল হক জানান, ওই ইউনিয়নের ৩৮টি গ্রামের মধ্যে অন্তত ২০টি প্লাবিত হয়েছে। গজারমারি-খারনৈ, বাউসাম-গজারমারি কচুগড়া-হাজংপাড়া সীমান্ত সড়কের বিভিন্ন অংশ তলিয়ে গেছে এবং কিছু কিছু জায়গায় মারাত্মক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে।
কলমাকান্দার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল রানা বলেন, উপজেলার চার ভাগের তিন ভাগ এলাকাই প্লাবিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ চাওয়া হয়েছে।