সৈকতে মদের বোতল, বর্জ্য ও বিপন্ন কাছিমের উৎস খুঁজতে তদন্ত কমিটি
সামুদ্রিক জোয়ারের কক্সবাজার সৈকতে ভেসে আসা মদের বোতল, গৃহস্থালি পণ্যসহ নানা বর্জ্য ও কাছিমের বিপন্ন হওয়ার উৎস্য খুঁজতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কক্সবাজার বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসারকে প্রধান করে সোমবার সন্ধ্যায় ৭ সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়।
সৈকতের বালিয়াড়ির সায়মন বিচ থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত এলাকায় আকস্মিক বিপুল বর্জ্য ভেসে আসার উৎসের সন্ধান করবে এই কমিটি। সামুদ্রিক কাছিম ও অন্য প্রাণী বিপন্ন হয়ে তীরে ভেসে আসার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে খতিয়ে দেখবে সাগরে পরিবেশ দূষণের বিষয়টিও, এমনটি জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, সৈকতে ভেসে আসা বর্জ্য পরিষ্কারের কাজ চলছে। এরপর এনজিওর মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়ে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামা হবে। কাছিমের মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে সোমবারই ভেসে আসা কাছিম উদ্ধার করে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ও পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপ-পরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, ময়নাতদন্তের পর সামুদ্রিক প্রাণীটির মৃত্যুর কারণ অন্তত জানা যেতে পারে বলে আশা করা যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, জোয়ারে বর্জ্য ভেসে আসার পরিমাণ কমলেও মৃত ও অর্ধমৃত সামুদ্রিক কাছিম ও সাপ ভেসে আসা অব্যাহত রয়েছে। সোমবারও বহুসংখ্যক কাছিম সৈকতে ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে এসেছে।
গত ২০ মে থেকে সাগরে যেখানে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে, সেখানে গভীর সাগরের তলদেশের প্রাণী কাছিমসহ সামুদ্রিক সাপ ভেসে আসার বিষয়টি সামুদ্রিক বিজ্ঞানীদেরও বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। কী কারণে এমন অসময়ে কাছিম মারা যাচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তারা।
কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের (এফআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুর রহমান জানান, ডিসেম্বর-জানুয়ারির শীত মৌসুমটা সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন সময়। তখন কাছিম ডিম দিতে তীরে উঠে আসে। কিন্তু এ বর্ষার সময় কেন কাছিম মারা যাচ্ছে বা বিপন্ন হচ্ছে, তা ভাববার বিষয়।
বর্জ্যের কারণে আকস্মিক সাগরের পানি দূষণের শিকার হয়েছে কি না, তাও পরীক্ষা করা হয়েছে। কক্সবাজারস্থ গবেষণাগারের ল্যাবে সোমবার করা পরীক্ষায় সাগরের পানি স্বাভাবিক পাওয়া গেছে। তবু অধিকতর পরীক্ষার জন্য ঢাকায় সামুদ্রিক জোয়ারের পানি পাঠানোর কথাও জানান তিনি।
গত শনিবার সাগরে ভেসে আসা বর্জ্য নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। অনেকেরই ধারণা, বর্ষার প্রথম বর্ষণে উজানের পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে কক্সবাজার-চট্টগ্রামের বহু নদী ও খাল দিয়ে সাগরে ভেসে যায় টন টন বর্জ্য। মেরিন ড্রাইভের রেজু, বাঁকখালী, মনখালীসহ অনেক নদী ও খাল দিয়ে সাগরে গড়িয়ে পড়ে বর্জ্য। সাগরতীরে আসা বর্জ্যগুলো এরই অংশবিশেষ।
আবার অনেকের মতে, ভেসে আসা বর্জ্যের বোতল ও প্লাস্টিকসহ অন্যান্য সামগ্রী দেশীয় ব্যবহারের নয়। জালগুলো যেহেতু ট্রলারেই অংশ, তাই ভাঙা প্লাস্টিক চেয়ারগুলো ফিশিং ট্রলার বা জাহাজে ব্যবহার হওয়া পণ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিএফআরআই কক্সবাজার কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশরাফুল হকের নেতৃত্বে সৈকতের বর্জ্য পরিদর্শন করা দলের প্রাথমিক ধারণা, বর্জ্যগুলো হয়তো জাল দিয়ে আটকানো ছিল। বৈরি আবহাওয়ায় তা ছিটকে, বর্জ্যের আটকানো জালসহ ভাসতে ভাসতে সৈকতে এসে যায়। জালের বিশাল থলির সঙ্গে সামুদ্রিক কাছিম ও সাপ আটকা পড়ে ভেসে আসে। অনেকগুলো কাছিম জালে আটকানোর মতো আহতও দেখতে পাওয়া গেছে।
সৈকত পরিচ্ছন্নতার কাজে নেতৃত্ব দেওয়া কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) ইমরান জাহিদ খান জানান, সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে শুরু করে দরিয়ানগর ও হিমছড়ি পর্যন্ত পরিচ্ছন্নতার কাজ চালানো হচ্ছে। বিচ ও পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মী এবং লাকড়ি কুঁড়োনো দরিদ্র নারী-পুরুষও ভেসে আসা বর্জ্য তুলে নিয়ে গেছেন।
স্থানীয়রা জানান, শনিবারের পর থেকে কমপক্ষে অর্ধশত মৃত কাছিম ভেসে এসেছে। সেইসঙ্গে আহত ও আধমরা অবস্থায় উদ্ধার করা কাছিমের সংখ্যা হবে অর্ধশতাধিক।
সোমবারও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সৈকতে ভেসে আসা কমপক্ষে দুই ডজন কাছিম উদ্ধার করে, জীবিত কাছিমগুলোকে সাগরে গভীর পানিতে ছেড়ে দিয়ে এসেছেন উদ্ধারকর্মীরা।
খবর পেয়ে কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সাংসদ সাইমুম সরোয়ার কমল বৃহস্পতিবার বিকেলে সৈকত এলাকা পরিদর্শনে যান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বর্ষায় পাহাড়ি ঢলসহ নানা বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে স্থান নেয়। আবার সাগরে অবস্থান করা বড় জাহাজে অবস্থানকারী অনেকেই মদের বোতলসহ অন্যান্য ব্যবহার্য পণ্যগুলোও অনেক সময় সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। আগে সমুদ্র এসব হজম করত। তৈলাক্ত দ্রব্য বেশি ছড়িয়ে তেজস্ক্রিয়তা বাড়ায় এখন তীরের বর্জ্য তীরেই ফিরিয়ে দিচ্ছে সাগর। আমরা সচেতন না হলে এটি চরম উদ্বেগ ছড়াবে।