হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ হয়নি, পরিকল্পনা বহির্ভূত ২৫ প্রকল্প
সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের ফসল রক্ষায় সরকার প্রতিবছর বরাদ্দ দিয়ে থাকে। বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হাওরের বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। কিন্তু এ বছর হাওরের ফসল রক্ষায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের টাকায় হাওর বহির্ভূত ২৫টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। যেখানে সরকারের ব্যয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা।
হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও কৃষকরা বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় বলে দাবি করলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড এই খরচকে অপ্রয়োজনীয় বলতে নারাজ। তবে তারা ফসল রক্ষার টাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামত ও সংস্কারের কথা স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এতে কোনো অপচয় হয়নি। ১৫ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এই কাজ ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা আজও শেষ হয়নি। এখনও প্রকল্পগুলোর ২৫ ভাগ কাজ বাকি রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত খরচার হাওরে ২০১৬ সালে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার রাবার ড্যাম নির্মাণ করে। তাই হাওরটি এখন পর্যন্ত সুরক্ষিত আছে। কিন্তু এবার ওই হাওরের ফসলরক্ষার কথা বলে নামকা ওয়াস্তে গণশুনানি করা হয়। শুনানি করেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন নাহার রুমা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সদর উপজেলার উপ-সহকারী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম। তারা উভয়েই চলতি নদীর বাম তীরে এক কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে সাতটি প্রকল্প গ্রহণ করেন।
প্রতিটি প্রকল্পই নদী তীরের রাস্তার উপরই নেওয়া হয়েছে। একই নদীর ডান তীরে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে আরও দু'টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলোকে ফসলরক্ষার জন্য অপ্রয়োজনীয় বলছেন কৃষক, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ প্রকল্প গ্রহণে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হিসেবেই মেরামত ও সংস্কারে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
জগন্নাথপুর উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর বাম তীরে পাঁচটি প্রকল্পে এ কোটি ১৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পেরও হাওরের ফসল রক্ষায় কোনো কাজে আসবে না। একই নদীর শাল্লা উপজেলা অংশে ডান তীরে তিনটি প্রকল্পে ৪৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দোয়ারাবাজার উপজেলার খাসিয়ামারা নদীর দুই তীরে আরও চারটি প্রকল্পে ৬২ লাখ টাকার বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এভাবে হাওরের ফসলরক্ষার বাঁধের বরাদ্দ অন্য কাজে ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে।
জামালগঞ্জের পাগনার হাওরের প্রয়োজনীয় 'বড়বান্দ' এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বাঁধে কোনো বরাদ্দ না দিয়ে ফসলরক্ষার অপ্রয়োজনীয় এমন প্রকল্প গ্রহণ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে গত ২৮ ডিসেম্বর দুদক সচিব দিলোয়ার বখতের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এসব বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন। তাছাড়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায়ও এসব অভিযোগ করেন হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।
এদিকে এলাকাবাসীর অভিযোগ, নদীতীরের ওই বাঁধগুলো মাটির বদলে বালি দিয়ে করা হচ্ছে। ফলে বাঁধগুলোতে কাজ করা হলেও টেকসই হচ্ছেনা। পানি এলে আবারও বাঁধের বালু সরে যাবে। এই প্রকল্পগুলোর কাজ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ করার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন ওই সময় পর্যন্ত ৭৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শহিদ নূর আহমেদ বলেন, এ বছর হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের ছড়াছড়ি রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের সঙ্গে অনেক অক্ষত বাঁধেও সমান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া হাওর নেই এমন স্থানেও একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করে সরকারের টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। আমরা সরেজমিন ঘুরে এসে গত ৮ ফেব্রুয়ারি পানিসম্পদ মন্ত্রীর কাছে এসব বলেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, দুদকের সচিব, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা এসব নিয়ে কথা বলেছি। আমরা স্মারকলিপিও দিয়েছি। তারপরও হাওরের বরাদ্দের টাকায় নদীতীর রক্ষার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক স্থানে প্রয়োজনীয় প্রকল্পও নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, নদীতীর রক্ষায় সরকার আলাদা বরাদ্দ দিক; আমাদের আপত্তি নেই- কিন্তু হাওরের কৃষককে বঞ্চিত করে অন্য প্রকল্পে টাকা ব্যবহার ঠিক নয়।
সুনামগঞ্জ-সিলেট সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামীমা শাহরিয়ার বলেন, জামালগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ হাওর পাগনার হাওর। এই হাওরের বড়বান্দ খ্যাত বাঁধে স্থানীয় কৃষকরা বলার পরও প্রকল্প নেওয়া হয়নি। আমিও কৃষকদের পক্ষে অনুরোধ করেছিলাম। এখানে প্রকল্প নেওয়া হলে কৃষকরা উপকৃত হতেন।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন নাহার রুমা চলতি নদীর ডান ও বামতীরের বাঁধগুলো হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নয় স্বীকার করে বলেন, ''গণ শুনানিতে অংশ নেওয়া কৃষক ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আমি সভাপতি হিসেবে অনুমোদন দিয়েছি।''
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ ও হাওরের ফসলরক্ষা মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব সবিবুর রহমান বলেন, নদী তীরের প্রকল্পগুলো বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ হিসেবে প্রকল্পভূক্ত করা হয়েছে। এগুলো হাওরের ফসলরক্ষার কথা বিবেচনা করে বাস্তবায়ন করা হয়নি। এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এতে কোনো অপচয় হয়নি।