হাসপাতালে বাড়ছে শিশু নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা
দুই দিনের জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর জানা যায় এক মাসের শিশু পপি মন্ডল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। চিকিৎসাধীন অবস্থায় খিঁচুনি শুরু হয় তার। বর্তমানে রাজধানীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালের শিশু নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছে সে।
এক সপ্তাহ আগে তিন দিনের জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয় দেড় বছরের শিশু মিথিলা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত সে। বর্তমানে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি আছে মিথিলা।
আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশুরা। ঢাকাসহ সারাদেশের হাসপাতালগুলোর শিশু ওয়ার্ডে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগী বাড়ছে। ৬ মাস থেকে ৩ বছর বয়সীরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। গরমে শিশুদের শরীরে যাতে ঘাম বসে না যায় সে বিষয়ে সতর্ক হওয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে অ্যান্টিবায়োটিক না দেয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ বলেন, "অক্টোবর-নভেম্বর মূলত শিশুদের নিউমোনিয়ার সিজনাল পিরিয়ড। তবে এবার একটু আগেই শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালে শিশুদের মধ্যে এখনো ডেঙ্গু রোগী বেশি। সামনে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত আরও বাড়বে"।
ডা. ইফফাত আরা আরও বলেন, "নিউমোনিয়া একটি ভাইরাসজনিত ইনফেকশন। অন্যান্য ইনফেকশনে যেমন পরিচ্ছন্ন থাকতে হয় এটাতেও তাই। শিশুদের শ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে কি না, জ্বরের পরিমাণ কেমন এগুলো দেখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো যাবে না"।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে ঠান্ডা জ্বর, নিউমোনিয়ায় প্রতিদিন গড়ে ২০০ শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে।
ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি জেলা সদর হাসপাতালে বেড়েছে নিউমোনিয়ার প্রকোপ। অধিকাংশ হাসপাতালে বেডের তুলনায় অতিরিক্ত নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি আছে।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে বেড রয়েছে ২৬টি। বুধবার সেখানে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিল ১১০টি শিশু। বেডের অভাবে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে রোগীরা। সেপ্টেম্বর মাসের ২২ দিনে হাসপাতালটিতে ৬০০ এর বেশি নিউমোনিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছে।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. অসীম কুমার সরকার টিবিএসকে বলেন, "প্রতিদিন নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে গড়ে ২৬ থেকে ৩০ জন করে রোগী ভর্তি হচ্ছে। সাতক্ষীরায় ডেঙ্গু রোগী কম হলেও নিউমোনিয়া রোগী অনেক বেশি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নিউমোনিয়া রোগীর চাপ বেশি থাকবে বলে মনে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় এক শিশু মারা গেছে"।
ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শাহনেওয়াজ বলেন, "হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া রোগী অনেক বেড়ে গেছে। ৪৫ বেডের শিশু ওয়ার্ডে এখন নিউমোনিয়া আক্রান্ত ৯৬ শিশু ভর্তি আছে। দিনে গরম আবার রাতে ঠান্ডার কারণে বাচ্চাদের ঠান্ডা লেগে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তিন বছরের কম বয়সী শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বাচ্চাদের গায়ে যেনো ঘাম না বসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের ব্রেস্টফিডিং করতে হবে"।
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৪০ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। আট বেডের বিপরীতে বর্তমানে ভর্তি আছে ১১৪ শিশু।
বাগেরহাটের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, "ঋতু পরিবর্তনের কারণে শিশু রোগী অনেক বেড়েছে। গত এক মাসে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে সাড়ে চার হাজার শিশু নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগে ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালের ২৪ বেডের শিশু ওয়ার্ডে ৪৫ জন নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি আছে"।
প্রতিদিন নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংকটাপন্ন রোগী ভর্তি হচ্ছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ শফি আহমেদ বলেন, "হাসপাতালে নিউমোনিয়া আক্রান্ত ভর্তি শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করায় মানুষ বেশি বাইরে যাচ্ছে। গরমের মধ্যে বাইরে ঘোরাঘুরি করলে শিশুরা বেশি ঘামে। ঘাম বসে গিয়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। তাই শিশুদের সাবধানে রাখতে হবে"।
দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) এর মতে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় ২৮% এর মৃত্যুর জন্য দায়ী নিউমোনিয়া। প্রতি বছর প্রায় ৫০,০০০ শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়।