১,৫০০ কোটি টাকার মাস্টারপ্ল্যানে জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রাণীদের খাঁচামুক্ত পরিবেশে রাখার পরিকল্পনা
প্রাকৃতিক আবাসের মতো পরিবেশে ঢাকার জাতীয় চিড়িয়াখানায় প্রাণী রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এভাবে প্রাণীরা খাঁচামুক্ত পরিবেশে মুক্ত বিচরণ করবে, আর নিরাপদ দূরত্ব থেকে তাদের দেখে চোখ জুড়াবে দর্শণার্থীদের।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এজন্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাণিবান্ধব করে গড়ে তোলা হবে জাতীয় চিড়িয়াখানাকে। ইতোমধ্যে এক মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা ডিসেম্বরে চূড়ান্ত হবে।
নতুন মাস্টারপ্লানের অধীনে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক আবাস অনুযায়ী প্রাণীদের জন্য আলাদা আলাদা পাঁচটি জোন করা হবে। জোনগুলো ঘিরে গড়া হবে প্রাকৃতিক বেষ্টনী; যা পার করে প্রাণীদের কাছে দর্শণার্থীরা যেমন যেতে পারবেন না, তেমনি প্রাণীরাও বেরিয়ে আসতে পারবে না।
জোনগুলোর একটি হবে বাংলাদেশের প্রাণীদের আবাস স্থলের আদলে, একটি হবে আফ্রিকার প্রাণীদের জন্য। এছাড়া নিশাচর এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের প্রাণীর আবাস অনুসারে আলাদা দুটি জোন হবে। আরেকটি জোন হবে শিশুদের খেলাধুলার জন্য।
এ মহাপরিকল্পনা অনুসারে, সম্পূর্ণ চিড়িয়াখানার চারিদিক থেকে সীমানা প্রাচীর দেওয়াসহ হবে নানা ধরনের সৌন্দর্য-বর্ধনের কাজ। চিড়িয়াখানার মধ্যেই স্থান পাবে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। থাকবে দুটি গেট, নৌকা চলাচলের জন্য দুটি রুট, লেকের ওপর ভাসমান একটি রেস্তোরাঁ এবং শিশুদের খেলাধুলার একটি জোন।
নতুন মাস্টারপ্ল্যানের বিষয়ে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. আব্দুল লতিফ টিবিএসকে বলেন, 'প্রাণিবান্ধব চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা এখানে প্রাণী ও মানুষের মাঝে অদৃশ্য বা প্রাকৃতিক খাঁচা তৈরি করব। দর্শনার্থীরা প্রাণীগুলোর স্ব স্ব অঞ্চলের আবহ পাবেন। ঠিক যেমন প্রাকৃতিক আবাসে এসব প্রাণী থাকে, তা ফুটিয়ে তোলা হবে। ডিসেম্বরে মাস্টারপ্ল্যানটি পাস হলেই উন্নয়ন কাজের প্রস্তুতি শুরু হবে'- বলে জানান তিনি।
মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রায় ৭৭ হেক্টর জায়গায় স্থান পাবে ২২৩ প্রজাতির প্রাণী। যার মধ্যে অঞ্চল ভেদে থাকবে ১০২ প্রজাতির দেশীয়, ৬৬ প্রজাতির গ্রীষ্মমণ্ডলীয়, ৪০ প্রজাতির আফ্রিকান এবং ১৫ প্রজাতির নিশাচর প্রাণী। এছাড়া শিশুদের একটিভ জোনে থাকবে ১০ প্রজাতির প্রাণী।
ম্যানগ্রোভ ওয়াটারল্যান্ড ফরেস্ট থিমে বাংলাদেশ হ্যাবিটেট জোনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭.৬৮ হেক্টর জমি। যেখানে ১০২ প্রজাতির দেশীয় প্রাণীর জন্য নির্ধারিত এলাকাকে সাজানো হবে সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বাদাবনের আদলে। জলাভূমির মাঝে মাঝে থাকবে বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল। এতে থাকবে ২৬ প্রজাতির মাছ, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৪ প্রজাতির পাখি এবং ১২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
ট্রপিক্যাল হ্যাবিটেট জোনে ৬৬ প্রজাতির প্রাণীর জন্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন অর্থাৎ চিরসবুজ বনের আদলে সাজানো হবে ১৪.৪৮ হেক্টর জমি। এখানে ২৬টি প্রাকৃতিক খাঁচায় ৭ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪৫ প্রজাতির পাখি এবং ১৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী থাকবে।
আফ্রিকান হ্যাবিটেট জোনে মহাদেশটির কাভাঙ্গো অঞ্চলের আদলে ২৩.১৬ হেক্টর এলাকায় আফ্রিকার পরিবেশে বিচরণকারী প্রাণীদের নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে ২০টি প্রাকৃতিক বেষ্টনী বা খাঁচায় থাকবে ৪০ প্রজাতির প্রাণী। যার মধ্যে ৩ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬ প্রজাতির পাখি এবং ২১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী স্থান পাবে।
নকটার্নাল বা নিশাচর প্রানীর হ্যাবিটেট জোন ঘন জঙ্গলের আদলে গড়ে তোলা হবে ৩.৭৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে। যাতে ১৫টি প্রাকৃতিক বেষ্টনী বা খাঁচায় থাকবে ১৫ প্রজাতির প্রাণী। এর মধ্যে ২ প্রজাতির সরীসৃপ, একটি প্রজাতির পাখি এবং ১২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রাখা হবে।
চিড়িয়াখানার মধ্যেই অ্যাকটিভ জোনে শিশুদের বিনোদন, অ্যাডভেঞ্চার এবং শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর জন্য ৫.৩৮ হেক্টর এলাকা জুড়ে ১০টি প্রাকৃতিক খাঁচা বা বেষ্টনীতে রাখা হবে ৪ প্রজাতির পাখি এবং ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
এছাড়াও চিড়িয়াখানার ৩.৪৮ হেক্টর এলাকায় জলাভূমি তৈরি, ১.১ হেক্টর এলাকায় নার্সারি এবং দুটি প্রধান প্রবেশ পথের জন্য মোট ৩.৫২ হেক্টর ভূমি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চিড়িয়াখানা থেকে বের হওয়ার পথ এবং পার্কিং এর জন্য রাখা হয়েছে আরও ৪.৭ হেক্টর এলাকা।
মাস্টারপ্লানের আওতায়, চিড়িয়াখানার মধ্যে সাড়ে সাত কিলোমিটার জুড়ে থাকবে ৫টি হাঁটার পথ। দুটি ট্রাম রুট থাকবে যার দূরত্ব ২.৪ কিলোমিটার। নৌকা চলাচলের জন্য দুটি রুট থাকবে ২.৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের। ভাসমান রেস্তোরাঁয় সেখানে বার্ড শো এবং ডলফিন শো করার চিন্তা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।
চিড়িয়াখানায় পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকবে। পশুর বর্জ্য রিসাইক্লিং করা হবে, যেন পরিবেশ দূষণ না হয়। চিড়িয়াখানার কর্মী ও সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য থাকবে আলাদা আলাদা রাস্তা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে।
এখানে পরিচালকদের জন্য আলাদা একটা বাসা থাকবে। সেখানে শিশুদের খেলার মাঠ থাকবে, শিশুপার্ক থাকবে বিনোদনের জন্য।
এর আগে ২০১৮ সালে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক কোম্পানি বার্নার্ড হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস এবং বাংলাদেশি ফার্ম দেশ উপদেশ- এর সহযোগিতায় ঢাকা ও রংপুর চিড়িয়াখানার জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের প্রকল্প নেয়। যা ২০২০ সালের জুলাইয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে মহাপরিকল্পনার খসরা ১৪ নভেম্বরে কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়।
এপ্রসঙ্গে দেশ উপদেশ লিমিটেডের ডেপুটি টিম লিডার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে আমরা জাতীয় চিড়িয়াখানার জন্য কাজ করছি। ডিসেম্বরে মাস্টারপ্লান চূড়ান্ত হলে কর্তৃপক্ষ আগামী বছর থেকেই কাজ শুরু করতে পারবেন। পরিকল্পনায় আমরা স্থানীয় প্রাণী ও গাছপালাকে প্রাধান্য দিয়েছি।'
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, 'আমরা চিড়িয়াখানা দেখতে দুবাই, সিঙ্গাপুর, হংকং কিংবা বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় যাব না। বাংলাদেশের চিড়িয়াখানা বিশ্বমানে পৌঁছে যাচ্ছে। এখন বিশ্বের অন্যান্য প্রান্ত থেকে মানুষ বাংলাদেশের চিড়িয়াখানা দেখতে আসবে।'