সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই রেলের ৩০ ইঞ্জিন ক্রয়, লোকোমোটিভ সংকট কাটছে না
রেলওয়ের সক্ষমতা বাড়িয়ে যাত্রী সেবার মান উন্নয়নে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১,১৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আমদানি করা হয়েছে মিটারগেজের ৩০টি ইঞ্জিন। কিন্তু চলাচলের উপযোগিতা না থাকায় সংকটের মধ্যেও সব রুটে চালানো যাচ্ছে না এসব ইঞ্জিন। অথচ রেলের ইঞ্জিন সংকট কাটাতে সবার চোখ ছিল আমদানি করা এসব লোকোমোটিভের (ইঞ্জিন) দিকে।
মূলত ইঞ্জিনের ওজন বেশি হওয়া, পুরোনো সেতুভার না নেওয়া, পুরাতন রেল ট্র্যাক ও বিভিন্ন স্টেশনের শেডের চেয়ে ইঞ্জিনের উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে সব রুটে চালানো যাচ্ছে না এসব নতুন লোকোমোটিভ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যেকোন বড় ধরণের ক্রয় বা প্রকল্প গ্রহণের আগে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা বাধ্যতামূলক। আমদানির আগে ইঞ্জিনগুলো কোন কোন রুটে চলবে, কোন কোন স্টেশনে থামবে, চালানোর উপযোগিতা আছে কিনা, এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত ছিল। এসব প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করলে এমন পরিস্থিতি হওয়ার কথা নয়।"
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ১০ বছর পর রেলে যুক্ত হয়েছে নতুন মিটারগেজ ইঞ্জিন। ২০১৮ সালের ১৭ মে ইঞ্জিনগুলো কিনতে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে চুক্তি করে রেল মন্ত্রণালয়। কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে ২৯৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রথম ধাপে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে আনে ১০টি লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন)। পরে আরেকটি প্রকল্পে ৮৪১ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয়ে আরো ২০টি লোকোমোটিভ কেনা হয়। ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভগুলোর (ইঞ্জিন) সিরিজ নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০১ থেকে ৩০৩০ পর্যন্ত।
রেলের মেকানিক্যাল বিভাগের তথ্যমতে, পুরোনো ভারী ইঞ্জিনগুলোর গড় ওজন প্রতি এক্সেলে ১১ দশমিক ৯৬ লোডের হিসাবে (প্রতিটি ইঞ্জিনে ৬ এক্সেল) ৭০ থেকে ৭২ টন। বর্তমানে আমদানি হওয়া ও আমদানির প্রক্রিয়ায় থাকা ইঞ্জিনগুলোর গড় ওজন ৯০-৯৫ টনেরও বেশি (প্রতি এক্সেলে ১৫ থেকে ১৬ টন)। রেলের পুরোনো ট্র্যাক এবং শতবর্ষী সেতুগুলোতে এই ভারী ইঞ্জিন চলতে পারছে না।
মূলত কালুরঘাট রেলওয়ে সেতু, ভৈরব পুরাতন সেতু, কুশিয়ারা সেতু, ঘোড়াশাল (আপ) সেতু, শম্ভুগঞ্জ সেতু, ঘুমঘাট সেতু ও ছাতক-সিলেট রুটের ২৮ নং সেতু- এই সাত সেতুতে নতুন ইঞ্জিনগুলো চলতে পারছে না। এছাড়া বিভিন্ন রুটের রেল ট্র্যাক পুরাতন হওয়ায় নতুন ইঞ্জিনগুলো এসব রুটে চলাচল করতে পারছে না।
রেলের অভ্যন্তরীণ এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ৩০০০ সিরিজের লোকোমোটিভে হুইল বড় হওয়ায় ও লোকোমোটিভ ক্যাপের উচ্চতা কম হওয়ায় লোকোমাস্টার (ট্রেন চালক) সিট থেকে দাঁড়ালে তার মাথা ছাদে লেগে যায়। নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দেওয়ানগঞ্জ ও কুলাউড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম শেডের উচ্চতা নতুন ইঞ্জিনের উচ্চতা থেকে কম। ফলে এসব স্টেশনে চলাচল করতে পারছে না। এছাড়া পুরাতন ট্র্যাকের যেসব স্টেশনে চলাচলের উপযোগিতা নেই সেগুলো সংস্কার করতে হবে।
রেলের পরিবহন বিভাগের তথ্যমতে, সেবাদানকারী সংস্থাটিতে মোট ১৫৯টি মিটারগেজের ইঞ্জিন রয়েছে। এরমধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। এখানে ২০ বছর আয়ুষ্কালের কোন কোন ইঞ্জিন ৫০ বছরের বেশি সময় ধরেও চলছে। দৈনিক ১১৬টি ইঞ্জিনের চাহিদা থাকলেও ত্রুটির কারণে মাত্র ১০০-১০৫টি নিয়মিত চালাতে পারে রেলওয়ে। এই সংকট দূর করতেই দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমদানি করা নতুন ৩০টি ইঞ্জিন যুক্ত করা হয়। দৈনিক মিটারগেজের আন্তঃনগরে এ শ্রেণির ২৪টি ট্রিপ, বি শ্রেণির ৩৮টি ট্রিপ এবং সি শ্রেণির ১১টি ট্রিপ চলে। নতুন যুক্ত হওয়া ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ১১টি আন্তঃনগর যাত্রীবাহী ট্রেনে চালানো হয়। আর ১০টি পণ্যবাহী (গুডস) ট্রেনে চলে। বাকি ৯টি স্পেয়ার ইমার্জেন্সি অ্যান্ড আন্ডার রিপেয়ারিং-এ রাখা হয়েছে।
রেলের দুই অঞ্চলের মেইন লাইনের মিটারগেজের মোট ১০টি রুট রয়েছে। এছাড়া স্বল্প দূরত্বের কিছু সাইড রুটেও মিটারগেজের ইঞ্জিন চলাচল করে। পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং পশ্চিমাঞ্চলের ঢাকা-পার্বতীপুর-দিনাজপুর-পঞ্চগড়, ঢাকা-রাজশাহী এই চারটি রুটে নতুন যুক্ত হওয়া ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলো বর্তমানে চলছে। উপযোগিতা না থাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ-জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ, ঢাকা-ভৈরর-গৌরিপুর-ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম-সিলেট, চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ, ঢাকা-নোয়াখালী, ঢাকা-সিলেট রুটের মতো বড় ছয়টি রুটে প্রায় ১,১৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ইঞ্জিনগুলো চলতে পারছে না।
ব্রিটিশ আমলে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা-জগতি অংশে ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল। দেড়শ বছরে ২৯০০ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৪ জেলায় রেল যোগাযোগ রয়েছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল নামে দুটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। পূর্বাঞ্চলের বেশিরভাগ রেল ট্র্যাক মিটারগেজ এবং পশ্চিমাঞ্চলের ব্রডগেজ।
পূর্বাঞ্চল রেলের ৩০টি ইঞ্জিন ক্রয় প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '৩০টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছিল রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে। ইঞ্জিনের পরিবর্তে ইঞ্জিন কেনার ক্ষেত্রে সেভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় না। তবে কয়টি ইঞ্জিন প্রয়োজন, এ বিষয়ে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান যাচাই করে চাহিদা দিয়েছিল। পুরাতন মডেলের লোকোমোটিভ বিশ্বের কোথাও এখন আর তৈরি করা হয় না। প্রতি বছর অন্তত ২০টি করে লোকোমোটিভ কেনা দরকার আমাদের। কিন্তু আমরা তো বাড়াতে পারছি না।'
সব রুটে নতুন লোকোমোটিভ চলাচল করতে না পারার কারণ হিসেবে সময়মতো রেললাইন সংস্কার না হওয়াকে দুষছেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, 'সময়মতো রেললাইন সংস্কার হলে লোকোমোটিভগুলো চলতে পারতো। সিলেট ও ময়মনসিংহ সেকশনের আরো আগেই উন্নয়ন করার কথা ছিল। ময়মনসিংহ সেকশনে কয়েকটি ব্রিজ সংস্কার করা হচ্ছে। তা শেষ হলেই সেখানেও চলতে পারবে। সিলেট সেকশনের কাজ যে প্রকল্পে হওয়ার কথা ছিল, তা বাতিল হয়েছে।'
উপযোগিতা যাচাই না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার ও পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মন্তব্য করতে রাজি হননি।