ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে বাড়ছে চায়ের উৎপাদন খরচ
ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সারাদেশের নিত্যপণ্যের বাজারে পড়ার পর এবার চা বাগানগুলোতেও পড়তে শুরু করেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় চায়ের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।
চলতি মাসের শুরুতে ডিজেলের দাম ৮০ টাকা থেকে বেড়ে লিটার প্রতি ১১৪ টাকায় গিয়ে ঠেকে। এর ফলে প্রতি কেজি চা উৎপাদনে খরচ বেড়েছে প্রায় ২০ টাকা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এভাবেই চা উৎপাদন খরচ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চা বাগান মালিকরা।
বাগান থেকে সবুজ চা পাতা উত্তোলনের পর সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে (ডায়িং) ব্যবহৃত হয় ডিজেল। প্রতি কেজি চা ডায়িং করতে খরচ হয় ৩৫০ এমএল (মিলি লিটার) ডিজেল। এছাড়া, সেচ এবং যন্ত্রপাতির ব্যবহারেও ডিজেল ব্যবহার হয় চা বাগানে।
ফটিকছড়ির আধারমানিক চা বাগানের ব্যবস্থাপক আখতারুজ্জামান মন্ডল বলেন, "আমাদের বাগানে সপ্তাহে ২০০ লিটার এবং সেচের সময় সাপ্তাহে ১ হাজার লিটার ডিজেল ব্যবহার হয়।"
"আমরা পার্শ্ববর্তী চা বাগানে সবুজ পাতা বিক্রি করি। আগে কেজি প্রতি সবুজ পাতা উৎপাদনে খরচ পড়তো ১৩২ টাকা; এখন খরচ পড়ছে ১৫০ টাকা। বছর ৫ লাখ কেজি সবুজ পাতা উৎপাদন হয় কারখানায়। ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন থেকেই আমরা লোকসানে পড়ে গেছি", যোগ করেন তিনি।
চা বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিলেটের কিছু বাগানে চা পাতা ডায়িং করতে গ্যাসের ব্যবহার হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম,পঞ্চগড়ে ডিজেল এবং কয়লা ব্যবহার হয়। তবে ডিজেলের ব্যবহারই হয় বেশি।
ডিজেলের দাম বাড়ায় চা পাতা শুকানো, বাগানে সেচ, যন্ত্রপাতি পরিচালনাসহ অন্যান্য ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু চা বিক্রি করে বাড়তি এই ব্যয় তুলে আনা সম্ভব হয় না। কারণ নিলামে চা বিক্রির দাম সেই তুলনায় বাড়েনা। এমন পরিস্থিতিতে চা উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানান বাগান মালিকরা।
তারা আরও জানান, করোনাকালীন অর্থাৎ, ২০২০ সাল থেকে দেশের চা শিল্পে বিপর্যয় শুরু হয়। করোনায় দেশের হোটেল রেস্তরাঁ বন্ধ থাকায় চা বিক্রি কমে যায়। ফলে উৎপাদনের চেয়ে কম দামে চা বিক্রি করতে হয়েছিল তাদের।
গত বছরের ৪ নভেম্বর ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা অর্থাৎ, লিটার প্রতি ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বৃদ্ধি করোনাকালীন ক্ষতিকে আরো উস্কে দেয়। চা বাগান মালিকরা তখন কেজি প্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা লোকসানে চা বিক্রি করেন।
করোনা এবং গত বছরের ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ক্ষতি এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেননি চা বাগান মালিকরা। এরমধ্যে গত ৬ আগস্ট ডিজেলের দাম এক লাফে ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা হয়ে যাওয়ায় চা শিল্প নতুন করে সংকটের মুখে পড়েছে। চা উৎপদনের এমন ভরা মৌসুমে খুশির বদলে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন চা উৎপাদনকারীরা।
ফটিকছড়ির দাঁতমারা এলাকার একটি বড় টি স্টেটের ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, "আমাদের টি স্টেটে চা পাতা উত্তোলন করে কারখানায় প্রতিদিন ৬০০ কেজি চা প্রস্তুত করা হয়। এ কাজে প্রতিদিন ৪০০ লিটার ডিজেল ব্যবহার হয়।"
"আগে ১ কেজি চা প্রস্তুত করতে খরচ হতো প্রায় ১৮০ টাকা। এখন খরচ পড়ছে কেজি প্রতি ২০০ টাকা। চায়ের মান ভেদে নিলামে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকার কম দামে। এখনই লোকসান শুরু হয়েছে কারখানায়। দু একমাস পর বাগানে চা পাতা সংগ্রহের পরিমাণ এবং গুণগত মান কমে যাবে। তখন ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে", যোগ করেন তিনি।
বাগান থেকে উৎপাদিত চা, মালিকরা চা বোর্ডের নিবন্ধিত ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠায়। এরপর চা বোর্ড এসব চায়ের মান যাচাই করে লট আকারে দাম ও গ্রেড নির্ধারণ করে। ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানের তৈরি ক্যাটালগে চায়ের গ্রেড ও প্রস্তাবিত দাম নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে।
চা সংসদের সদস্য ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবারের নিলামে গিয়ে ক্যাটালগ দেখে নিলামের নিয়ম অনুযায়ী বিডিংয়ের মাধ্যমে চা ক্রয় করে। এক্ষেত্রে ক্যাটালগের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি বা কম দামে নিলামে বিক্রি হয় বাগান মালিকদের পাঠানো চা।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের একজন সিনিয়র সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "চায়ের দাম নির্ভর করে সরবরাহ ও চাহিদার ওপর। ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, যার ফলে মালিকদের লোকসান হচ্ছে। এই বিক্ষোভের কারণে চা উৎপাদনকারীরাও ক্ষতির মুখে পড়েছেন।"
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড়ে ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে কাজ করেন দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক।
এছাড়া, উত্তরবঙ্গ এবং বান্দরবানে চা চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন আরো ৫ হাজার ক্ষুদ্র চাষী। চট্টগ্রামের চা বাগানে কাজ করেন প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক। চট্টগ্রাম জেলায়ও রয়েছে ১৮টি টি স্টেট এবং ৩টি চা বাগান।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য মোতাবেক, ২০২২ সালে দেশে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১০০ মিলিয়ন কেজি। এর মধ্যে জুন পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ২৭.০৬ মিলিয়ন কেজি। কেবল জুনেই উৎপাদন হয়েছে ১২.৫৯ মিলিয়ন কেজি।
২০২১ সালে দেশের চা বাগানগুলোতে চা উৎপাদন হয়েছিল রেকর্ড ৯৬.৫০৬ মিলিয়ন কেজি।