নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেও কাজে ফেরেননি বেশিরভাগ বাগানের চা শ্রমিকরা
প্রধামন্ত্রীর আশ্বাসে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও সোমবার বেশিরভাগ বাগানের শ্রমিকরা কাজে যোগ দেননি।
ফলে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা আসলেও এখন পর্যন্ত অচলাবস্থা কাটেনি চা বাগানগুলোতে। বরং নেতাদের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ বিরাজ করছে শ্রমিকদের মধ্যে।
রোববার (২১ আগস্ট) রাতে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের সাথে চা শ্রমিক নেতাদের বৈঠক হয়। এই বৈঠকে জানানো হয়, অচিরে প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিক নেতাদের সাথে বসে তাদের মজুরি নির্ধারণ করে দেবেন এবং দাবি দাওয়া পূরণে পদক্ষেপ নেবেন।
এই আশ্বাসের পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করে পূর্বের ১২০ টাকা মজুরিতেই কাজে ফেরার সিদ্ধান্তের কথা জানান চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা।
আজ সোমবার (২২ আগস্ট) সকালে চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের এই সিদ্ধান্ত ছড়িয়ে পরার পর শ্রমিকদের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দেয়। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, বেশিরভাগ বাগানেরই শ্রমিকরা কাজে যোগ দেননি।
কয়েকটি বাগানের শ্রমিকরা সকালে কাজে যোগ দিলেও দুপুরের দিকে আবার ফিরে আসেন। আর হবিগঞ্জের লক্সরপুর ভ্যালির ২৩ বাগানের শ্রমিকরা তাদের ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।
কাজে যোগ না দেওয়া সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের শ্রমিক নবীন মুন্ডা বলেন, "নেতাদের কথা আমরা বিশ্বাস করি না। তারা আমাদের সাথে প্রতারণা করছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে সরাসরি তার আশ্বাসের কথা শুনতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস পেলে আমরা কাজে ফিরে যাব।"
সরেজমিনে দেখা যায়, লাক্কাতুরা, দলদলিসহ ৩/৪ টি বাগানের কিছু শ্রমিক ছাড়া সিলেট ভ্যালির বাকি বাগানগুলোর শ্রমিকরা সোমবার কাজে যোগ দেননি। এই ভ্যালিতে ২৩ টি বাগান রয়েছে। একই অবস্থা মৌলভীবাজারেও। সেখানকার বেশিরভাগ বাগানের শ্রমিকরাও কাজ বিরত রেখেছেন।
কাজে যোগ দেওয়া লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিক সবিতা হাজরা বলেন, "খেয়ে না খেয়ে ধর্মঘট করলাম। কিন্তু আন্দোলন করে আমরা কি পেলাম। কেবল স্লোগানই দিলাম- ৩০০ টাকা মজুরি দে। কিন্তু কোন লাভ তো হলো না।"
"আমাদের কামলা খাটা জীবন। কামলাই খেটে যেতে হবে। আমাদের কোন উন্নতি নেই। তাই কাজে চলে আসছি।"
ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও সোমবার শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়নি বলে জানিয়েছেন সিলেটের খাদিম ও শ্রীমঙ্গলের জঙ্গলবাড়ি চা বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল রশিদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েও আজকে তারা ধর্মঘট করছে। কোথাও কাজ করছে না।
এ ব্যাপারে মালনীছড়া চা বাগানের শ্রমিক রিতেশ মোদী বলেন, "আমরা চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের অপেক্ষায় আছি। তারা আসলে তাদের সাথে কথা বলে আমাদের সিদ্ধান্ত নেব।"
চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, "কাল প্রায় ভোর রাতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে সিদ্ধান্তের লিখিত কপি আজ সব বাগানে পাঠানো সম্ভব হয়নি। একারণে শ্রমিকদের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা রয়েছে। আশা করছি কাল থেকে সবাই কাজে যোগ দেবে।"
এদিকে, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন হবিগঞ্জের লস্করপুর ভ্যালির ২৩টি চা বাগানের শ্রমিকরা।
সোমবারও তারা বিভিন্ন বাগানে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন। এ সময় তারা ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি ছাড়া কাজে ফিরবেন না বলে জানান।
একই সঙ্গে ১২০ টাকা মজুরিতে কাজে যোগ দেয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করায় চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
চান্দপুর চা বাগানের শ্রমিক বীরেণ তন্তুবায় বলেন, 'আমরা আজকে ১৪ দিন ধরে কর্মবিরতি করছি ৩০০ টাকা মজুরির জন্য। এতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন মজুরি না বাড়িয়ে কাজে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।'
রাতের আঁধারে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা ১২০ টাকা মজুরিতে যে স্বাক্ষর করেছেন, সেটি তারা মানেন না বলেও জানান বীরেন।
চুনারুঘাটের চান্দপুর চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সাধন সাঁওতাল বলেন, 'আমাদের শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি কাজে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়নি। তারা যদি প্যাডের মাধ্যমে চিঠি দিয়ে কাজে যাওয়ার নির্দেশনা দেয় তাহলে আমরা কাজে যাব, তবে অবশ্যই ৩০০ টাকা মজুরি নিয়ে। এর কমে হলে আমরা কাজে যাব না।'
বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার বলেন, 'আমাদের শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা রাতের আঁধারে গিয়ে হাত মিলিয়েছে। তাতেও লাভ হবে না। ৩০০ টাকা মজুরি ছাড়া কোনো শ্রমিক কাজে ফিরবে না।'
গত ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন চা শ্রমিকরা। ধর্মঘটের ৮ দিনের মাথায় শনিবার দুপুরে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের কার্যালয়ে শ্রম অধিপ্তর ও সরকারের প্রতিনিধির সাথে বৈঠকে বসেন চা শ্রমিক নেতারা।
গতকাল বৈঠক শেষে শ্রমিক নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানান। তবে নেতাদের এই সিদ্ধান্ত জানানোর পরই ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাধারণ চা শ্রমিকরা। এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। তারা ২৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। পরে রাতে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা নিজেদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
এর একদিন পরই এর আগে রোববার মধ্যরাতে হঠাৎ করে আবার বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে বৈঠকে বসেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান। রাত ৩টার দিকে শেষ হওয়া ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নতুন মজুরি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান দৈনিক ১২০ টাকা মজুরী ঠিক রেখে চা শ্রমিকের আজ থেকে কাজে যোগ দিবেন।
এছাড়া শ্রমিকেরা যে কয়দিন কর্মবিরতি পালন করেছেন, মালিকপক্ষ তাদের নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকদের মজুরী প্রদান করবেন বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের অর্থ-সম্পাদক পরেশ কালিন্দি বলেন, আপাতত আমরা পূর্বের মজুরিতেই কাজে যোগ দেবো। তবে দ্রুততম সময়ে প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে আলাপ করে নতুন মজুরি নির্ধারণ করবেন। আর ধর্মঘট চলাকালীন ১০ দিনের মজুরিসহ সকল সুবিধাদি মালিকপক্ষ প্রদান করবে।
বৈঠক শেষে জেলা প্রশসকের প্যাডে একটি যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়। তাতে উল্লেখ রয়েছে- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে তার সম্মানে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ২২ আগস্ট থেকে কাজে যোগদান করবেন। আপাতত চলমান মজুরি অর্থাৎ ১২০ টাকা হারেই শ্রমিকগণ কাজে যোগদান করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স পরবর্তীতে মজুরির বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনার পর চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হবে।
আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হওয়ার জন্য চা-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ আবেদন করবেন যা জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপস্থাপিত হবে। চা-শ্রমিকদের অন্যান্য দাবিসমূহ লিখিত আকারে জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করবেন। জেলা প্রশাসক প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য তার কার্যালয়ে পাঠাবেন।
এই বৈঠকে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া, বিভাগীয় শ্রম দপ্তর উপ-পরিচালক মো. নাহিদুল ইসলাম, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।