একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শত শত নারী ও তাদের সাফল্যের গল্প
মাত্র তিন মাস মেয়াদী কারিগরি প্রশিক্ষণে চাকরি মেলে। চাকরির চ্যালেঞ্জিং বাজারে অবাক হওয়ার মতো এ বিষয়টি সম্ভব করেছে বগুড়ার এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
মা ফাতেমা (রা.) মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্স থেকে গত ৯ বছরে অন্তত ৭৭৮ জন প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। তাদের মধ্যে ৫৬০ জন প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পরপরই চাকরি পেয়েছেন।
মা ফাতেমা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ৫ বছর আগে এসেছিলেন তাজরীনা আক্তার। বাড়ি দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জে। বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারের আর্থিক সংকট দেখা যায়। নিজে কিছু করবেন এমন চিন্তা থেকে খোঁজ করতে থাকেন তাজরীনা। এমন অবস্থায় তার মামা সন্ধান দেন বগুড়ার মা ফাতেমা (রা.) মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্সের। সেখানে মোটরসাইকেল সার্ভিস মেকানিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন।
তিন মাস প্রশিক্ষণ শেষে চাকরি হয় প্রাণ আরএফএলের হবিগঞ্জের ফ্যাক্টরিতে। ঘটনা ২০১৭ সালের মার্চে। এরপর থেকে এই কোম্পানিতেই রয়েছেন। তবে বদলেছে তার কর্মস্থল। বর্তমানে রয়েছেন রংপুরে দুরন্ত বাইক ফ্যাক্টরিতে। পেয়েছেন পদোন্নতি; সহকারী থেকে এখন তিনি অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার আয়েই স্বচ্ছলতা এসেছে পরিবারের।
আর্থিক অনটনের সংসার, প্রশিক্ষণ আর চাকরি জীবন নিয়ে কথা হয় তাজরীনার সাথে। স্মৃতিচারণ করে বলেন, "তখন (প্রশিক্ষণের আগে) পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। বাবাও নেই। বড় বোন প্রতিবন্ধী। মা, মেজ বোন, আমি আর ছোট ভাই মিলে সংসার। অভাবের পরিবারে বিয়ের জন্য চাপ অনুভব করছিলাম নিয়মিত। কিন্তু আমার চিন্তায় কাজ করছিল, আগে নিজে কিছু করব; তারপর বিয়ে।"
"পরিকল্পনা তেমন ছিল না, শুধু চেয়েছিলাম, কোনোকিছু শিখে দক্ষ হয়ে একটা সম্মানজনক চাকরি করা। বগুড়ার এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আমাকে ওই সুযোগ এনে দেয়। প্রশিক্ষণ শেষে বদলে গেছে জীবনের গতিপথও।"
চাকরির পর থেকে সংসারের হাল পুরোপুরি না ধরতে হলেও সিংহভাগ বহন করতেন তাজরীনা। জানান, ছোট ভাইকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করিয়েছেন। বাড়ির নানা খরচ সামলাতে হতো। এখন ভাই দিনাজপুর বাড়িতে কাজ করে। সংসারের সেই অভাবটি এখন কমেছে।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর কোল ঘেঁষে ২০০০ সালে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। ২০০৬ সালে কেন্দ্রটি রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তি লাভ করে।
মা ফাতেমা (রা.) মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্সে তিনটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তা হলো কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিশিয়ান ও মোটরসাইকেল সার্ভিসিং মেকানিক।
এ কমপ্লেক্সে সারিয়াকান্দি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাসহ ১৩ জন রয়েছেন। এর মধ্যে ইউসেপ সংস্থার রয়েছেন ৫ জন।
জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর মা ফাতেমা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচলনা করে। আর কারিগরি সহায়তা দেয় বেসরকারি সংস্থা ইউসেপ। ২০১৪ সালে এক সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে এই কার্যক্রম শুরু হয় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও ইউসেপ।
জেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চুক্তির পর থেকে মা ফাতেমায় প্রশিক্ষণ নিতে আসেন ৮২৮ জন। এর মধ্যে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন ৭৭৮ জন নারী। এর মধ্যে কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স বিষয়ে ২৭২ জন নারী প্রশিক্ষিত হয়েছেন। আর ইলেকট্রিশিয়ান বিষয়ে ২৫৪ এবং মোটরসাইকেল সার্ভিসিং মেকানিকে ২১০ জন। এদের মধ্যে ৫৬০ জন নারীকে দেশের স্বনামধন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়।
চাকরির করার গল্প বাদেও সুখবর পাওয়া গেলো দিনাজপুরের শাহিনা খাতুনের সাথে কথা বলার পর। তাজরীনার সাথে একই ব্যাচে কনজ্যুমার ইলেক্ট্রনিক্স বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন শাহিনা। কয়েকবছর চাকরি করে এখন তিনি তার প্রতিষ্ঠানেই জুনিয়রদের কাজে তদারকি করছেন।
প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৭ সাল থেকে প্রাণ আরএফএলের বেস্ট ইলেকট্রনিক্সে চাকরি জীবন শুরু করেন ২৭ বছর বয়সী এই উদ্যমী নারী।
শাহিনা বলেন, "আমরা যে কাজ করি তা অনেক পরিশ্রমের। অনেকে টিকতে পারেন না। অনেকে চাকরি পেয়েও পরে চলে গেছেন। তবে যারা প্রয়োজনটাকে গুরুত্ব দেন; তারা টিকে যান। আর চাকরি করতে হলে কষ্ট হবেই।"
অষ্টম শ্রেণি পাশ থাকলেই এখানে ভর্তি হতে পারেন মেয়েরা। তিন মাসের প্রশিক্ষণকালীন বিনামূল্যে থাকা-খাওয়াসহ ৯০০ টাকা ভাতা ও সনদ পান তারা।
এখানে প্রথম দিকে হাঁস-মুরগি ও গরু পালন, টেইলারিং, লন্ড্রি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। পরে নারীদের যুগোপযোগী কাজ শেখার জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ চালু করে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত হলেও মূলত বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ইউসেপ।
কারিগরি কাজ শেখার পর প্রাণ আরএফএল, ম্যানোকা মটরস, ওয়ালটন, শোভন গ্রুপসহ আরো কয়েকটি কোম্পানি তাদের নিয়োগ দেয়। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কর্মী নিয়েছে প্রাণ আরএফএল।
নদী পাড়ের এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কারণে উত্তরবঙ্গের কিছু নারীর জীবনমান পাল্টে গেছে বলে দাবি করেন মা ফাতেমা (রা.) মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্সের লিড প্রশিক্ষক ও ইউসেপ সংস্থার কর্মকর্তা শামসুল তাবরেজ।
তিনি জানান, "উত্তরাঞ্চল তথা দেশের সবখানে সরকারের পাশাপাশি আমরা নারীদের সাবলম্বী করার চেষ্টা করছি। পুরুষ ছাড়া দুস্থ নারীদের কাজের উপযোগী করে রাজস্বখাতে অংশ নেওয়ার মতো করে গড়ে তোলা হচ্ছে।"
তাবরেজের কাছে থেকে জানা যায়, এখন বেশিরভাগ মেয়েরা আসেন আগের প্রশিক্ষণার্থীদের মাধ্যমে খবর পেয়ে। এ ছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে উঠান বৈঠক করে মেয়েদের প্রশিক্ষণ নিতে আহ্বান করা হয়। এতে ভালো সাড়া পাওয়া যায়।
করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর এই প্রতিষ্ঠানে চলতি বছরের মার্চে নতুন ৫০ নারী প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করছেন। তাদেরও কর্মস্থল নির্ধারিত হয়ে গেছে।
এই ব্যাচের কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স বিষয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এলিফা টুডু। আর্থিক দৈন্যতার কারণে ২০১৭ সালে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই বন্ধ হয়ে যায় তার শিক্ষাজীবন। পরে ঘোড়াঘাটের একটি বেসরকারি সংস্থা মাধ্যমে খবর পেয়ে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন। তার চাকরি হয়েছে প্রাণ আরএফএলের হবিগঞ্জ ফ্যাক্টরিতে।
এলিফা টুডু বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে চাকরি পাওয়ার পর মনে হলো নতুন জীবন পেতে যাচ্ছি। এখানে আমরা বিভিন্ন ধরনের লাইট তৈরি, ফ্যানের মেশিন সেট করা শিখেছি।
এ প্রশিক্ষণার্থী আরও বলেন, "ভাবতেই ভালো লাগছে এখন বাড়িতে আর অভাব থাকবে না। টাকার অভাবে আমার বোনের পড়াশোনা বন্ধ হবে না। আমি তাকে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই।"
মোটরসাইকেল সার্ভিসিং মেকানিকের প্রশিক্ষণার্থী সাজিনা আক্তার সুমনা কারিগরি বিষয় শেখার আগ্রহ থেকে ভর্তি হন মা ফাতেমা (রা.) প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। তার বাড়ি ধুনট উপজেলায়। পড়ছেন সরকারি আজিজুল হক কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষে।
তিনি বলেন, "কাজ শেখার পর এখন অনেক ভালো লাগছে। আমরাও ছেলেদের মতো সমানতালে কাজ করতে পারব। এখন স্বপ্ন একটাই; ভালো চাকরি করা। পরিবারকে সাপোর্ট দেওয়া।"
এ কমপ্লেক্সে ইলেকট্রিশিয়ান বিভাগের প্রশিক্ষক হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন আয়েশা সিদ্দিকা।
তিনি বলেন, "বগুড়া ছাড়াও আশেপাশের অনেক জেলা থেকে মেয়েরা কাজ শিখতে আসছে। তাদের কাজ শেখাতেও ভালো লাগে। আরও একটি ভালো লাগার বিষয়, প্রতি ব্যাচেই আমরা বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মেয়েদের পাই। এবারও ১২ জন মেয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।"
দেশে এমন আরও সাতটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। তবে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয় মাত্র দুটিতে। একটি বগুড়ায় এবং অপরটি গাজীপুরে।
বেশি কারিগরি ট্রেড ও দক্ষতার দিক থেকে বগুড়ার কেন্দ্রটি সবচেয়ে ভালো উল্লেখ করে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের জেলা উপরিচালক শহিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, "করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। এ বছর জানুয়ারি থেকে নতুন একটি ব্যাচ চালু হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণও শেষ। ২৮ মার্চ প্রাণ কোম্পানি থেকে একটি দল এসে মেয়েদের নিয়োগের বিষয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছে। নতুন এই ব্যাচটির ৫০ জনের মধ্যে ৪৭ জনের চাকরি তারা নিশ্চিত করেছেন।"
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি নিয়ে তিনি আরও বলেন, "এখানকার আয়তন হিসেবে আরও বেশি নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব। কিন্তু ভবনের অভাবে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা চাইলেও বাড়ানো যাবে না। মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে নতুন উদ্যোগ নিলে নারীদের জন্যই সবচেয়ে ভালো হবে।"