ডেঙ্গুতে শিশুদের অবস্থাই বেশি নাজুক
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান স্বপ্নিল বাহাদুর (৭) রাজধানীর বিএফ শাহীন স্কুলের ক্লাস ওয়ানে পড়তো। জ্বর, বমি ও পেটব্যথা নিয়ে গত ৮ জুলাই রাজধানীর আদ-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি হয় স্বপ্নিল। ডেঙ্গু টেস্ট নেগেটিভ আসলেও তার ব্লাডে প্লাটিলেটের মাত্রা ছিলো ৭০ হাজার। প্লাটিলেট দেয়ার পর তাকে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে ডেঙ্গু টেস্টে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ জুলাই মারা যায় স্বপ্নিল। মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় 'ডেঙ্গু শক সিনড্রোম'।
স্বপ্নিলের মত সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের ক্লাস ওয়ানের শিক্ষার্থী আরফিয়ার ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছিলো মৃত্যুর কারণ 'ডেঙ্গু শক সিনড্রোম'। তিনদিনের জ্বর ও কাশি নিয়ে রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ সেপ্টেম্বর মারা গেছে সে। স্বপ্নিলের মতো বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল আরফিয়াও।
একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা স্বপ্নিল ও আরফিয়ার পরিবার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ৯ মাসে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৩৯ জন, এর মধ্যে অন্তত ৮ জন শিশু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যের বাইরেও ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যুর তথ্য রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে এখন পর্যন্ত ৪ জন শিশু মারা গেছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সে সংখ্যা ৭। এছাড়া স্বপ্নিলের মৃত্যুর তথ্যও নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডাটায়।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকা শহরের মাত্র ৩৩টি হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দেয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় ডেঙ্গুতে শিশুদের অবস্থা বেশি নাজুক। শিশুদের ডেঙ্গুর লক্ষণ বুঝতে দেরি হওয়ায় দেরিতে হাসপাতালে নেয়ার কারণে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, 'শিশুরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে বিপদ বেড়ে যায়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে ইন্টারনাল রক্তক্ষরণ অনেক বেশি হয়। শিশুরা অল্পতেই শকে চলে যায়। কিডনি, লিভার ফেইলিওর শিশুদের খুব দ্রুত হয়। সে কারণে ডেঙ্গুতে শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি।'
ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, 'দিনের বেলা শিশুরা ঘুমালে মশারি টানাতে হবে, ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখতে হবে। জ্বর আসলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কোথাও স্বচ্ছ পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। সচেতন থেকে ডেঙ্গুকে রুখতে হবে।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আরও দু'জনের মৃত্যু হয়েছে।
একই সময়ে আরও ৩৫৩ জন আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছেন।
দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এই মুহূর্তে মোট ১,২১৩ জন ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এ বছরের শুরুতে প্রতি মাসে দুয়েকজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি থাকলেও গত আগস্টে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১০০ ছাড়ায়। হাসপাতালের তথ্য বলছে, এ বছর এখন পর্যন্ত ২৬৬ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছে ৭ শিশু। বর্তমানে হাসপাতালটিতে ভর্তি আছে ২৮ শিশু, যদিও হাসপাতালটির ডেঙ্গু সেলে বেড আছে ১২টি। বাকি রোগীদের ডেঙ্গু সেলের বাইরে অন্য ওয়ার্ডে রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, 'শিশুদের জ্বর হলেই ডেঙ্গু টেস্ট করতে হবে। বেশি বেশি পানি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। প্রচন্ড পেট ব্যথা, বমি, প্রচন্ড মাথা ব্যথা- এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। আর্লি স্টেজে হাসপাতালে আনলে সুস্থ হয়ে যায় রোগী, তবে যত দেরি হয় ততো ঝুঁকি বাড়ে।'
শিশু হাসপাতালের বাইরে মিটফোর্ড হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও শিশু রোগী বাড়ছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হাসপাতালগুলোকে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, 'ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে হাসপাতালের পরিচালকদের চিঠি পাঠানো হয়েছে। ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট, চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করে রোগী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে।'
নাজমুল ইসলাম বলেন, 'শিশুদের ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট ঠিকমতো না হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। দেরি হয়ে গেলে রোগীর পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যায়। শিশুদের মৃত্যুর পেছনে এটা একটা বড় কারণ। জ্বর আসলে অভিভাবকরা অবহেলা করে দেরি করে হাসপাতালে আসছেন। শুরু থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না হওয়ায় রোগীর পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। তাই জ্বর হলে শিশুদের দ্রুত হাসপাতালে আনতে অনুরোধ করা হচ্ছে।'
দেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০০০ সালে। সে বছর ৫,৫০০ জন সংক্রমিত হয়েছিল, মারা যায় ৯৩ জন।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম ছিল। তবে ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ১০৫ জন। এ বছর আবারো বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশে ৮ হাজার ১৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।