ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ জটিলতায় চট্টগ্রাম বন্দরে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হ্যাপাগ-লয়েড
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ জটিলতায় ১৭ দিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে আছে জার্মানভিত্তিক শিপিং কোম্পানি হ্যাপাগ-লয়েডের একটি ফিডার ভেসেল (ছোট জাহাজ)। এতদিন ধরে জাহাজটি আটক থাকার কারণে কোম্পানি বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে বলে জানিয়েছে হ্যাপাগ-লয়েড।
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে ফিডার ভেসেল চালু করে জার্মানভিত্তিক এই কোম্পানি। কলম্বো থেকে পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের সময় গ্যান্ট্রি ক্রেনকে ধাক্কা দেওয়ায় গত ২৮ সেপ্টেম্বর হ্যাপাগ-লয়েডের জাহাজটিকে আটক করে বহির্নোঙ্গরে পাঠিয়ে দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আটকের পর জাহাজের স্থানীয় এজেন্টকে জানানো হয়, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং সমস্যা নিষ্পত্তির পর জাহাজটিকে বন্দর ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।
এদিকে জাহাজের শিপিং এজেন্ট জানিয়েছেন, জাহাজটি বসিয়ে রাখার কারণে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার ইউএস ডলার ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে কোম্পানি। যতদ্রুত সম্ভব বিষয়টি নিষ্পিত্তি হলে, তা দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য মঙ্গল।
জাহাজটি আটক হওয়ায় কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নির্ধারিত সময় (শিডিউল টাইম) অনুযায়ী প্রায় ১ হাজার ৪০০ টিইইউ (টুয়েন্টি-ফুট ইকুইভেলেন্ট ইউনিট) রপ্তানি পণ্য নিয়ে যেতে পারেনি। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে কয়েকটি জাহাজে করে কন্টেইনারগুলো কলম্বো বন্দরে পাঠানো হয়।
হ্যাপাগ-লয়েডের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, এই জাহাজের পণ্যগুলোর গত ৬ অক্টোবর কলম্বো বন্দরে মাদার ভেসেলের জন্য শিডিউল করা ছিল।
"পণ্যগুলো পাঠাতে দেরি হওয়ায় মাদার ভেসেল ধরা সম্ভব হয়নি। ফলে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌছাতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি রয়েছে," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফারোয়র্ডার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন বলেন, জাহাজের বিষয়টি যতদ্রুত সম্ভব সমাধান করা উচিত।
"কারণ দিনের পর দিন এভাবে একটি জাহাজ আটকে থাকলে মেরিটাইম বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং শিপিং কোম্পানির উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর পরিষেবা পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেওয়া," যোগ করেন তিনি।
হ্যাপাগ-লয়েডের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম কলম্বো ফিডার (সিসিএফ) সার্ভিসের আওতায় লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী কন্টেইনার জাহাজ হ্যান্সা রেন্ডসবার্গ কলম্বো বন্দর থেকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ১ হাজার ৭০০ টিইউএস কন্টেইনার নিয়ে আসে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ইয়ার্ডের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে টিবিএসকে বলেন, যে গ্যান্ট্রি ক্রেনকে জাহাজটি ধাক্কা দিয়েছে সেটি দুর্ঘটনার পরেও সচল রয়েছে।
এদিকে, দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির প্রধান করা হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ওয়ার্কশপ ম্যানেজার মোস্তফা ইকবালকে।
কমিটি গঠনের পর গ্যান্ট্রি ক্রেনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ শুরু করে পিঅ্যান্ডআই ক্লাব হউল অ্যান্ড মেশিনারি। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে সাড়া না পেয়ে এই কার্যক্রম থেকে সরে আসে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির হেন্ডারসন মেরিন বাংলাদেশ লিমিটেড জাহাজের ক্যাপ্টেন আহমেদ রুহুল্লাহ টিবিএসকে জানিয়েছেন, "জাহাজটির দুর্ঘটনার পর শুরুতে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের বিষয়ে আমাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। আমরা সার্ভে করেছিলাম। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসাব দেয়নি। পরবর্তীতে আমরা বিষয়টি আমাদের ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে জানিয়ে দিয়েছি।"
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, দাবি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাহাজটি আটক থাকবে।
"ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের বিষয়ে বন্দরের গঠিত কমিটিরি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে। কার অবহেলার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে কমিটি তা নির্ধারণ করবে। কবে নাগাদ বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে তা রোববার যোগাযোগ করলে বলা যাবে," যোগ করেন তিনি।
গভীরতা কম থাকায় বর্তমানে ৯ দশমিক ৫ মিটারের বেশি গভীরতার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে পারে না। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফিডার ভেসেলে করে কন্টেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর– শ্রীলঙ্কার কলম্বো, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং, তানজুম পেলিপাস বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়।
একইভাবে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি পণ্য প্রথমে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে খালাস করা হয়। এরপর ফিডার ভেসেল বা অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয়।
শিপিং শিল্পের কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ৪০ শতাংশ চট্টগ্রাম থেকে কলম্বো বন্দরে পরিবহন করা হয়। বাকি ৬০ শতাংশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং এবং তানজুং পেলেপাস হয়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে বিভিন্ন শিপিং লাইনের প্রায় ৬৪টি ফিডার ভেসেল চালাচল করে।
ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর ছাড়াও সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, তুরস্ক, চীন (হংকং) এবং যুক্তরাজ্যের বন্দরে সরাসরি পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। বর্তমানে, প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ পণ্য সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে এসব বন্দরে বহন করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে ইউরোপ-আমেরিকা-আফ্রিকায় পণ্য পরিবহনে প্রায় সবগুলো জাহাজের মেইন লাইন অপারেটরেরই ফিডার সার্ভিস চালু করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে ফিডার ভেসেল চালু করে জার্মানিভিত্তিক হ্যাপাগ-লয়েড। প্রাথমিকভাবে, মাসে দুই থেকে তিনটি ট্রিপ পরিচালনা করার সিন্ধান্ত নেয় প্রতিষ্ঠনটি।
হ্যাপাগ-লয়েডের জাহাজটি চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে নিজেদের পণ্য পরিবহনের জন্য হ্যান্সা শিপিং কোম্পানি থেকে ভাড়ায় নিয়ে আসে।
এর আগে, ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে ফিডার সার্ভিস চালু করেছিল হ্যাপাগ-লয়েড। সাফল্য না পাওয়ায় প্রথম যাত্রার পরই ফিডার সার্ভিস বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ১৭ বছর পর আবারও একই রুটে ফিডার সার্ভিস চালু করে হ্যাপাগ-লয়েড। কিন্তু পূর্বের মতোই আবারও প্রথম ট্রিপেই বাধাগ্রস্ত হলো সার্ভিসটি।