ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই ৭০% রোগীর: গবেষণা
দেশে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব এবং এ রোগের ঝুঁকি নিয়ে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৭০% ডায়াবেটিস রোগী এ রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনা।
ডায়াবেটিস রোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য স্থূলতা, শারীরিক কার্যকলাপ কমে যাওয়া, প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ এবং তামাক ব্যবহারকে দায়ী করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং চিকিত্সকরা। ডায়াবেটিক রোগীরা হৃদরোগ এবং কিডনির নানা সমস্যার পাশাপাশি অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
তাছাড়া, ডায়াবেটিক রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে। এ রোগে আক্রান্তদের অবশ্যই সঠিক ওষুধ, খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, প্রায় ৬১.৫ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগী জানেন না যে তারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন। আক্রান্তদের মধ্যে শুধুমাত্র ৩৫.২ শতাংশ রোগী নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করেন; এবং তাদের মধ্যে ৩০.৪ শতাংশের রোগ নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট সাতজন চিকিৎসা গবেষক চলতি বছরের জুনে পিএলওএস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটি পরিচালনা করেন।
চিকিৎসকদের মতে, হিমোগ্লোবিনের একটি রূপ HbA1c (গ্লুকোজ) ৬.৫ শতাংশের নিচে থাকলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
একজন মানুষের দেহে পরপর তিন মাসে রক্তে গড় শর্করার মাত্রা পরিমাপ করেই HbA1c পরীক্ষা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহাজাদা সেলিম বলেন, "ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, প্রজনন বিষয়ক নানা সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। ডায়বেটিস রোগীর ৮০ শতাংশ মারা যায় হার্ট অ্যাটাকে। ডায়বেটিস না থাকলে কিডনি রোগী অনেক কমে যেতো।"
তিনি আরো বলেন, "ডায়াবেটিসের কারণে চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায়। ৬১% মানুষ যারা মনে করে তাদের ডায়াবেটিস নেই, কিন্তু টেস্ট করলে দেখা যায় তাদের ডায়াবেটিসের মাত্রা এতো বেশি যে ওষুধ বা ইনসুলিন শুরু করতে হয়।"
"ডায়াবেটিস থেকে অন্য রোগ হওয়ার কারণে খরচ আরো বেড়ে যায়। ডায়াবেটিসে ব্যক্তির পাশাপাশি সরকারের ব্যয়ও বাড়ছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতের মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশ ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যয় হয়। সে কারণে ডায়বেটিস প্রতিরোধে গুরুত্ব দিতে হবে," বলেন এই অধ্যাপক।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। এ রোগ কখনো সম্পূর্ণ সারে না।
"চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নির্ধারিত নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চললে এবং প্রয়োজনে পরিমাণমতো ওষুধ গ্রহণ করলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ ও প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা থেকেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব," বলেন তিনি।
উদ্বেগ বাড়াচ্ছে গর্ভকালীন ডায়বেটিস
বাংলাদেশে প্রতি ১০০ গর্ভবতী নারীর মধ্যে ২৬ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের ও গর্ভস্থ শিশুদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাজাদা সেলিম বলেন, "উদ্বেগজনকভাবে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বাড়ছে। গর্ভকালীন ডায়বেটিস সন্তান পেটে থাকার সময় মায়ের ও সন্তানের সমস্যা করতে পারে, সন্তান প্রসবের সময়ও সমস্যা হতে পারে।"
"মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সন্তানের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৪০% বেড়ে যায়," বলেন তিনি।
পরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, "ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসায় টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৫০০০ রোগীকে ইনসুলিন ফ্রি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এছাড়া টাইপ-২ ডায়বেটিস আক্রান্ত রোগীদের দেশের ২০০টি এনসিডি কর্নারে ফ্রি ডায়াবেটিসের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। আগামীতে এ সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে।"
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও এ থেকে অন্য রোগের ঝুঁকি কমাতে বয়স ৪০ হলে সবাইকে ডায়াবেটিস পরীক্ষার পরামর্শ দেন তিনি।
'এক্সেস টু ডায়াবেটিস কেয়ার' প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ সোমবার সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস।