মধ্য-জানুয়ারিতে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হচ্ছে গভীর সমুদ্রের মুরিং, কমাবে জ্বালানি খালাসের সময়
আমদানিকৃত অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেল হ্যান্ডলিংয়ের দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে চলমান 'সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) এবং ডাবল পাইপ লাইন' নির্মাণ প্রকল্পের জানুয়ারির মাঝামাঝি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার পরিকল্পনা করছে কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯৪ শতাংশের কিছু বেশি।
এখন প্রকল্পটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার প্রস্তুতিমূলক কাজ চলছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শরীফ হাসনাত। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ট্রায়াল রান সফল হলে ২০২৩ সালের মার্চে প্রকল্পটি পুরোদমে চালু করা হবে।'
সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যাওয়া পাইপলাইনটি দিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ১ লাখ টন আমদানিকৃত তেল খালাস করতে পারবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই কাজটি করতে বর্তমানে ১১ দিন লাগে। কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) থেকে জ্বালানি স্থানান্তর করতে আর লাইটার জাহাজের (ছোট জাহাজ) প্রয়োজন পড়বে না। বর্তমানে মাদার ভেসেলকে আউটার অ্যাংকরেজে নোঙর করতে হয়।
পাশাপাশি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বছরে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় এবং দেশে আরও ১৫ দিনের তেল মজুতের সক্ষমতা বাড়বে বলেও জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
৯০ একর জমির ওপর পাম্পিং স্টেশন, ট্যাঙ্ক ফার্ম ও ছয়টি স্টোরেজ ট্যাঙ্ক নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।
ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংকের মধ্যে তিনটি পরিশোধিত এবং বাকি তিনটি অপরিশোধিত তেলের জন্য। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাঙ্কের ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার। অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাঙ্কের ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার।
প্রকল্প কর্মকর্তারা বলেন, সবগুলো ট্যাঙ্ক পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে প্রায় ১.৫ লাখ টন তেল মজুত রাখতে পারবে।
প্রকল্প পরিচালক শরীফ হাসনাত বলেন, 'এ প্রকল্পের আওতায় ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১১০ কিলোমিটারের কাজ শেষ। এই পাইপলাইনটি চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা হয়ে মহেশখালীকে পতেঙ্গা ডিপোর সাথে সংযুক্ত করেছে। এছাড়া ৭৪ কিলোমিটার অনশোর পাইপলাইনের কাজও শেষপর্যায়ে।'
তিনি আরও বলেন, 'ইস্টার্ণ রিফাইনারী লিমিটেডের জরুরি শাটডাউন হলে ব্যাকআপ হিসেবে পরিশোধিত তেল মজুত ও সংরক্ষণের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে।'
জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে, সাধারণত জাহাজ থেকে অপরিশোধিত তেল ও ফিনিশড পণ্য সরাসরি ভেসেল মুরিং পয়েন্টে চলে যাবে। সেখান থেকে পাম্প করে পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রথমে তেল আনা হবে মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাঙ্কে। সেখান থেকে আবার পাম্পের মাধ্যমে পাইপলাইনে করে পাঠানো হবে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ণ রিফাইনারীতে।
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশ্বিক সংকটের সময় এই প্রকল্পে তেলের মজুত তৈরি পারলে দামের দিক থেকে ব্যাপক সাশ্রয় হবে।
এ বিষয়ে কক্সবাজার চেম্বার অভ কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, 'দেশে আমাদের স্টোরেজ ক্যাপাসিটি অপ্রতুল ছিল। তাছাড়া বিদেশ থেকে মাদার ভেসেলে তেল আমদানি করা হতো। এগুলো পতেঙ্গার ডিপোতে ঠিকমতো আনলোড করতে অনেক সময় চলে যেতো।
'এখন যেহেতু গভীর সমুদ্র বন্দরের কাছাকাছি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে, তাই এটি বিরাট গুরুত্ব বহন করবে। পাশাপাশি আমরা যদি আমাদের তেলের মজুত সক্ষমতা বাড়াতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন বৈশ্বিক সংকটের ফলে সৃষ্ট সরবরাহ ঘাটতি এবং মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলা করতে পারব।'
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিপিসি ৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। অর্থায়নের সিংহভাগই আসছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে (৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা) প্রকল্প সহায়তা হিসেবে। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার ৬০১ কোটি টাকা এবং বিপিসি ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা দিচ্ছে।
প্রকল্পটির ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) ঠিকাদারের দায়িত্বে আছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিপিপিইসি)। এছাড়া জার্মানিভিত্তিক আইএলএফ কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ারস কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড দেখতে পায়, কর্মরত শ্রমিক-প্রকৌশলীরা ভবন রং করা, প্রকল্পের অভ্যন্তরীণ সড়ক উন্নয়ন, স্টোরেজের সঙ্গে বিভিন্ন অপটিক্যাল ক্যাবলের সংযোগ স্থাপন ও পাইপ লাইনের সংযোগ স্থাপনে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে জার্মানি ও চীনের ৭০ জন প্রকৌশলী কর্মরত রয়েছেন। তাদের নির্দেশনায় ২ শতাধিক স্থানীয় শ্রমিক শেষ সময়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। যদিও প্রকল্পের শুরু থেকে ৫০০-৬০০ বিদেশি নাগরিক কর্মরত ছিলেন।
জ্বালানি বিভাগের তথ্যানুসারে, ২০১৫ সালে নেওয়া সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় তিন দফা সংশোধন করে মেয়াদ বাড়িয়ে তা ঠেকেছে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।
বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৬ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেল আমদানি করে। এর মধ্যে অপরিশোধিত তেলের পরিমাণ ১.৪ মিলিয়ন টন।