বগুড়ায় মাঝ রাস্তায় বাস থেকে নামানো হলো যাত্রীদের, ভোগান্তি
বেলা একটা। ভরদুপুরে কোলে শিশু আর স্ত্রীকে নিয়ে মহাসড়কে উদ্বাস্তুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন আনোয়ার হোসেন। যাবেন কর্মস্থল ময়মনসিংহে। কিন্তু পথেই বগুড়ার তিনমাথা এলাকায় বাস থেকে তাদের নামিয়ে দিল পুলিশ। এরপর থেকে প্রায় এক ঘণ্টার মতো এই রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে তিনি।
তার আশেপাশে একই কারণে আরও অর্ধশত যাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। ভোগান্তির শেষ নেই, কিন্তু পুলিশ নিজের ইচ্ছেমতো যাত্রী নামিয়েই যাচ্ছে বলে অভিযোগ অনেকের।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বগুড়া শহরের তিনমাথা নিরালা পাম্প এলাকার বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কের প্রথম বাইপাসে গিয়ে এমন ঘটনা দেখা মেলে। রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য যাত্রীদের এভাবে নামিয়ে বাস রিকুইজিশন করা হচ্ছে বলে দাবি পুলিশের।
মাঝপথে বাস থেকে নেমে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন দিনাজপুর থেকে আসা আনোয়ার হোসেনও। বলেন, 'যেই বাসে চড়ে ময়মনসিংহে যাচ্ছিলাম, প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে পুলিশ সদস্যরা ওই বাসটি জব্দ করে নিয়ে গেছে। বাসে প্রায় অর্ধশত যাত্রী ছিল, সবাইকে নামিয়ে দিয়েছে।'
এই বাসযাত্রী আরও বলেন, 'আসলে কিছু বলার নেই, শক্তি থাকলে সবাই প্রয়োগ করে। মাঝপথে এভাবে নামিয়ে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রাখা মানে গায়ে পড়ে হয়রানি করা। পরিবার ও বেডিং নিয়ে রাস্তায় দিশেহারার মতো দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশের রাস্তার ধুলায় দমবন্ধ হয়ে আসছে।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভাগীয় নির্বাচনী জনসভা। সেখানে নিরাপত্তায় বগুড়া এপিবিএনের সদস্যরা কাজ করবেন। তাদের যাতায়াতের জন্য ছয়টি বাস প্রয়োজন। এজন্য টার্মিনালে না গিয়ে রাস্তায় যাত্রী নামিয়ে বাসগুলো রিকুইজিশনে জব্দ করছিল পুলিশ। যদিও তিনমাথা থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরত্বে বগুড়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল।
সরেজমিনে একাধিক বাসের অন্তত ৫০ জন যাত্রীকে দেখা যায়। কেউ মালামাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউবা রাস্তার ওপর বসে পড়েছেন। অনেকে রিকশা-ভ্যান খোঁজার চেষ্টা করছেন, যাতে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। পাশেই বগুড়া জেলা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দু'জন কর্মকর্তা ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) দু'জন সদস্য মহাসড়কে ঢাকাগামী বাসগুলো আটকে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছেন।
এ সময় কয়েকজন বাস যাত্রীদের সঙ্গেও কথা হয়। তেমনি একজন জহুরুল ইসলাম। তিনি পেশায় কাপড় ব্যবসায়ী। পাঁচ সহযোগী নিয়ে তিনি কাপড় বিক্রি করতে দিনাজপুরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বাসে করে টাঙ্গাইলে ফেরার পথে বগুড়ার তিনমাথায় তাদের নামিয়ে দেয় পুলিশ।
জহুরুল ইসলাম বলেন, 'আমিসহ বাসের সব যাত্রীদের নামিয়ে দিয়েছে। বাসের চালক সব কাগজ পুলিশদের দেখিয়ে অনেক অনুরোধ করার পরও গাড়ি ধরে নিয়ে গিয়েছে। আমি মূর্খ মানুষ এত কিছু বুঝি না। ঘণ্টাখানেক হলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে, এই মালামাল নিয়ে কই যাবো এখন!'
ঠাকুরগাঁও থেকে ময়মনসিংহ যাচ্ছিলেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ফারজানা রহমান। তিনি বলেন, 'আমি একা মেয়ে মানুষ এক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে। বাসায় বলার সাহস পাচ্ছি না। জানতে পারলে আব্বু-আম্মু টেনশনে জ্ঞান হারাবে। উনারা সরকারি কাজে গাড়ি জব্দ করবে ভালো কথা তবে এভাবে মাঝপথে কেন। এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। তারা বলেছেন অন্য গাড়িতে উঠিয়ে দিবেন।'
কোনো গাড়িতে নারী-শিশু যাত্রী থাকলে তা রিকুইজিশনে বিধি-নিষেধ রয়েছে। কিন্তু তা মানা হয়নি। গাড়ি রিকুইজিশন নিয়ে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৯ সালে কয়েক দফা নির্দেশনাসহ একটি রায় দেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, নারী, শিশু ও রোগী বহনকারী গাড়ি রিকুইজিশন করা যাবে না।
বগুড়ার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) মাহাবুবর রশিদ জানান, রাজশাহীতে এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী আসবেন। সেখানে এপিবিএন সদস্যরা নিরাপত্তা ডিউটিতে যাবেন। তাদের যাতায়াতে ছয়টি বাস প্রয়োজন এর মধ্যে চারটি বাস রিকুইজিশন করা হয়েছে।
মহাসড়কে মাঝপথে বাস রিকুইজিশনে করায় যাত্রী অসুবিধার কথা স্বীকার করেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। মাহবুবর রশিদ বলেন, 'সাময়িকভাবে কিছু অসুবিধা হয়েছে যাত্রীদের। তবে পরবর্তী বাসে আমরাই তাদের উঠিয়ে দিচ্ছি। মহাসড়ক ছাড়া টার্মিনালে গিয়ে বাস রিকুইজিশন করা সম্ভব হয় না। সেখানে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে সহযোগিতা করে না।'
রাস্তায় যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে বাস রিকুইজিশন করা মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করেন জেলা সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিন। তিনি জানান, 'রাষ্ট্রের অনেক অর্থ আছে, ব্যয়ের খাত আছে। সাধারণ মানুষ কোথাও ভ্রমণ করতে গেলে গাড়ি ভাড়া করে। তেমনি সরকারি দপ্তরের লোকজনও গাড়ি ভাড়া করে গন্তব্যে যাবে। এ কারণে রিকুইজিশনের ব্যবস্থাটা পরিবর্তন হওয়া উচিত।'
জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) হেলেনা আকতার বলেন, 'রাস্তায় যাত্রী নামিয়ে গাড়ি রিকুইজিশন করার কথা নয়। তবে রাজশাহীতে প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশের জন্য এপিবিএন সদস্যরা আগামীকাল (আজ) রওয়ানা দিবেন। এ জন্য গাড়ি জরুরি ছিল। রাষ্ট্রীয় কাজে আমাদের এই কাজ করতে হয়েছে।'