উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা, সীতাকুণ্ডে বনভূমির গাছ কেটে গড়ে উঠছে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড
উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বনভূমির গাছ কেটে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে তুলছে কোহিনুর স্টিল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে বনভূমির কয়েক হাজার গাছ কেটে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে প্রায় ৫ একর বনভূমি। ইস্পাত কারখানার বর্জ্য ফেলে সাগরের বেলাভূমি ভরাট করে ইয়ার্ডের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে দোতলা স্থাপনা।
গত বছর (২০২২ সাল) ১৪ ফেব্রুয়ারি সীতাকুণ্ডের উত্তর সলিমপুর ও তুলাতলি মৌজায় কোহিনুর স্টিলর মালিক কোহিনুর আক্তারকে এই বনভূমি ইজারা দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। কোহিনুর স্টিলকে বরাদ্দ দেয়া এই জায়গাটি তিন বছর আগে কোহিনুর আক্তারের স্বামী বিবিসি স্টিলের মালিক আবুল কাসেমকে ইজারা দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা মামলার রায়ে ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বিবিসির ইজারা বাতিল করে। ওই রায়ে বনভূমির ইজারা কার্যক্রমকে বেআইনি ঘোষণা করে আদালত। শুনানি শেষে আদালতের চূড়ান্ত রায়ে দেশের বনভূমির অব্যবস্থাপনা ও অপ্রতুলতার কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি গেজেটভুক্ত সকল বনভূমি সরকারকে বন আইনের অধীনে সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু এই একই জায়গা ভিন্ন মৌজা দেখিয়ে একই মালিকের অন্য প্রতিষ্ঠান কোহিনুর স্টিলকে ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এরপর গত বছরের আগস্টে পরিবেশগত ছাড়পত্রও পায় প্রতিষ্ঠানটি। অথচ সেখানে উপকূলীয় বন বিভাগের ১৫০ একর কেওড়াবাগান রয়েছে। এটি বন আইনের ৪ ধারায় সংরক্ষিত বনের তালিকাভুক্ত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সীতাকুণ্ডের উত্তর সলিমপুর এলাকার বেড়িবাঁধের পাশে মাটি কেটে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। কেওড়াগাছসহ আশেপাশের এলাকাটিতে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। কোহিনুর স্টিলের লোকজন পুরো এলাকাটি পাহারা দিচ্ছেন।
বেড়িবাঁধ থেকে নির্মাণাধীন ইয়ার্ডে প্রবেশ করতে দুটি সড়ক তৈরি করা হয়েছে ইতোমধ্যে। এই সড়ক তৈরিতেও কাটা হয়েছে কেওড়া গাছ। সাগরতীরে গাছ কেটে সেখানে ইস্পাত কারখানার বর্জ্য দিয়ে ভরাট করে ইয়ার্ড বানানো হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে কারখানার জন্য দোতলা কার্যালয়ও। স্কেভেটর দিয়ে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। নির্মাণাধীন ইয়ার্ডটির দুই পাশে (উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে) বেড়িবাঁধ থেকে সাগরের বেলাভূমি পর্য়ন্ত কেওড়া গাছ দেখা গেলেও ইয়ার্ডটিতে প্রায় তিন একর জায়গায় গাছ কেটে নির্মাণ কাজ করতে দেখা গেছে।
আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আবারো একই জায়গা ইয়ার্ডের জন্য ইজারা দেওয়ায় বেলা'র পক্ষ থেকে গত বছরের ২০ নভেম্বর উচ্চ আদালতে পিটিশন দাখিল করা হয়েছে। আগামী রোববার পিটিশনটি শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। পিটিশনে আদালত অবমাননা করে বনভূমি ইজারা দেয়ার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংস্থা-দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রুল জারি করে তাদের স্বশরীরে আদালতে হাজির হয়ে জবাব দেয়ার আবেদন করা হয়েছে। একইসঙ্গে বরাদ্দ দেয়া এই জমি বাতিলেরও আবেদন করা হয়েছে।
এর আগে গত বছরের ৮ অক্টোবর জেলা প্রশাসন, বন বিভাগ, কোহিনুর স্টিলসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষদের আইনি নোটিশ দিয়েছে বেলা। এছাড়া গত ১৯ সেপ্টেম্বর ও চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে আদালত অবমাননার নোটিশও দিয়েছে সংগঠনটি।
১৯৯৬ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বলা হয়- বনায়নের জন্য বন বিভাগের প্রয়োজন এমন কোনো এলাকার খাসজমি ভূমি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মতামত ব্যতীত কোন প্রকার ইজারা বন্দোবস্ত প্রদান করা যাবে না।
এই বিষয়ে বেলা'র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অবৈধভাবে সাগরপাড়ে সংরক্ষিত বনের জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উচ্চ আদালত এবং আপিল বিভাগের রায়ে বনবিভাগের জমি বন ব্যতীত অন্য কোনো কাজে ব্যবহার না করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। এরপরও শিপ ব্রেকিংয়ের জন্য এই জমি বরাদ্দ দেয়া আদালত অবমাননার শামিল।
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ২০১১ সালে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডকে শিল্প ঘোষণার পর সীতাকুণ্ডের সাতটি মৌজায় জমি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। কোহিনুর স্টিলকে লিজ দেয়া জমিটি এই শিল্প জোনের বাইরে এবং সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যে পড়েছে। ছাড়পত্র দেওয়ার আগে বন বিভাগের কোনো পরামর্শও নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর।
এদিকে পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিলের জন্য গত ৩১ অক্টোবর পরিবেশ অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে উপকূলীয় বন বিভাগ। এতে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাসহ বনাঞ্চল থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থায় ওই এলাকায় জাহাজভাঙা কারখানা হলে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
পরিবেশ ছাড়পত্র বাতিলের আবেদনের আগে গত বছরের ২ অক্টোবর ইজারা বাতিল করতেও জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছিল উপকূলীয় বন বিভাগ। এতে তিন বছর আগে বিবিসি স্টিলকে যে বনভূমি ইজারা দেওয়া হয়েছিল, কোহিনুর স্টিলকে দেওয়া ভূমিও একই স্থানে বলে উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে গত ২৩ অক্টোবর বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের উপস্থিতিতে সভা হয়। কিন্তু দুই পক্ষ নিজেদের অবস্থানে অনড় ছিল।
উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, কোহিনুর স্টিলকে বরাদ্দ দেয়া জায়গাটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত। যেখানে কেওড়াবাগান রয়েছে। তাই এই প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিলের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছি। বন বিভাগের জমি জবর-দখল ও কেওড়াবাগানের গাছ কাটার অভিযোগে গত বছরের ১৬ আগস্ট ও ২৫ সেপ্টেম্বর বন বিভাগের পক্ষ থেকে কোহিনুর স্টিলের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছে। এছাড়া বিষয়টি জানিয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে বিভাগীয় কমিশনারকে সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে বলেছে মন্ত্রণালয়।
এই বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার টিবিএসকে বলেন, জেলা প্রশাসনের ভূমি বরাদ্দের কাগজপত্র দেখে এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনেই ইয়ার্ডটিকে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে বন বিভাগের পক্ষ থেকে ছাড়পত্র বাতিলের একটি চিঠি পেয়েছি। যেখানে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাসহ বনাঞ্চল থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কাগজ পেলে কিংবা পরিবেশ ধ্বংসের কোন কাজ করলে আমরা ছাড়পত্র বাতিলসহ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেব।
জানতে চাইলে কোহিনুর স্টিলের মালিক আবুল কাশেম বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে নিয়ম মেনেই ইয়ার্ড তৈরি করা হচ্ছে। ইয়ার্ড তৈরি শেষে খালি জায়গাতে গাছ লাগানো হবে।