সীতাকুণ্ডে অস্ট্রেলিয়া-ফেরত উদ্যোক্তার স্বপ্নে যেভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন জনপ্রতিনিধিরা
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার অধিবাসী মো. তামজিদ রহমান (৩৫) পেশায় একজন অ্যাকাউন্টেন্ট। দেশের জন্য কিছু করতে অস্ট্রেলিয়ার বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে ফিরে এসেছেন মাতৃভূমিতে।
নিজের কষ্টার্জিত উপার্জন থেকে জমানো টাকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন কোম্পানি থেকে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এনে দেশের তৈরি পোশাকশিল্পে অবদান রাখার স্বপ্ন বুনছিলেন তরুণ এই উদ্যোক্তা।
এ লক্ষ্যে গত জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের চারালকান্দি গ্রামে আড়াই একর জমি কিনে শুরু করেন জান্নাত পলিটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ নামক একটি কারখানা স্থাপনের কাজ।
এ কারখানায় অন্তত ৫০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছিলেন তিনি। গার্মেন্টস ও গার্মেন্টস এক্সেসরিজ পণ্য রপ্তানি করে কারখানাটি শতকোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেবে — এমন প্রত্যয়ও ছিল তার।
কারখানা স্থাপনে জমি কেনা, মাটি ভরাট, সীমানা প্রাচীর ও কারখানার শেড নির্মাণসহ নানা কাজে ইতোমধ্যে তামজিদ বিনিয়োগ করেছেন সাত কোটি টাকা।
কিন্তু এ পর্যায়ে এসেই বড় এক ধাক্কা খান তরুণ এ উদ্যোক্তা। শুরু হয় এক চরম বিভীষিকা ও হয়রানির জীবন।
তামজিদ জানান, কারখানা স্থাপনের জন্য জমি প্রস্তুত করতে মাটি ভরাটের কাজ পেতে তার কাছে তিনটি পক্ষ আসে। স্বাভাবিকভাবেই, সবচাইতে কম দাম প্রস্তাবকারীকে কাজটি দেন তিনি। এরপর অপর দুই পক্ষ সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতি ঘনফুট বালি সরবরাহের জন্য তার কাছে ২ টাকা করে চাঁদা দাবি করে।
তামজিদের অভিযোগ, এ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে দিচ্ছেন বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য খায়রুল বশর। আর এতে খোদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদাকাত উল্লাহ মিয়াজির সম্মতি ছিল বলে দাবি করেন তামজিদ।
নিজের বড় ভাইয়ের সঙ্গে খায়রুল বশরের একটি রেকর্ড করা ফোনালাপ সরবরাহ করেন তামজিদ।
সেখানে কারখানার জমিতে বালু ভরাট করতে হলে তামজিদের কাছে প্রতি ঘনফুটে ২ টাকা করে চাঁদা দাবি করতে শোনা যায় একজনকে। চাঁদা দাবি করা ওই ব্যক্তি ইউপি সদস্য বশর বলে ভাষ্য তামজিদের। চাঁদা না দিলে সেক্ষেত্রে পরিষদের চেয়ারম্যান সাদাকাত উল্লাহ মিয়াজীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন ওই ব্যক্তি।
গত ২৪ জুন রাত ৯টায় সাহাবু্দ্দিন, সাজ্জাদ, লিটন ও আলাউদ্দিন নামক চার ব্যক্তি জান্নাত পলিটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় অবৈধভাবে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে কারখানার কেয়ারটেকার সাজ্জাদুল ইসলাম তাদের বাধা দেন।
এসময় তারা সাজ্জাদুল ইসলামকে মারধর করেন এবং ভয়ভীতি দেখান। এ অভিযোগে ওইদিনই থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন কেয়ারটেকার সাজ্জাদুল।
তামজিদের প্রতিষ্ঠান ততদিনে ট্রেড লাইসেন্স (ব্যবসার সনদ) পেয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রে একটি সবুজ শিল্প হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে।
এরপর গত ৪ নভেম্বর বিকেলে বাড়বকুণ্ডের নড়ালিয়া-চারালকান্দি এলাকার সড়কের প্রবেশমুখে পাইপ দিয়ে চলাচলের পথ বন্ধ করে দেন কিছু ব্যক্তি। এ সময় বাধা দিতে গেলে সাজ্জাদুল ইসলামসহ কারখানার নিরাপত্তারক্ষী, ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে গালিগালাজ ও মারধর করেন তারা।
একপর্যায়ে তারা নিরাপত্তারক্ষী সিরাজ উদ দৌলাকে কুপিয়ে জখম ও রক্তাক্ত করেন। এতে সিরাজের বাম হাতের ৩টি আঙুলের হাড়, ও রক্তনালী কেটে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে একজনকে আটক করে।
এ ঘটনায় তামজিদ রহমান বাদী হয়ে পরদিন থানায় মামলা করলে আসামিরা প্রতিষ্ঠানের ভুক্তভোগী নিরাপত্তারক্ষীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়া থেকে বিরত রাখে বলে অভিযোগ তামজিদের।
এছাড়া কারখানার বিরুদ্ধে অপপ্রচারও চালানো হচ্ছে বলেও জানান তামজিদ।
কারখানার বিষয়ে এলাকায় একটি প্রতিবাদ সভাও হয়। সেখানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদাকাত উল্লাহ মিয়াজি ও সদস্য খায়রুল বশর।
তামজিদ রহমান বলেন, 'তারা সভায় আমার প্রতিষ্ঠানকে নামবিহীন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিষয়টি আমাকে হতবাক করেছে। শিল্পকারখানা স্থাপনে জনপ্রতিনিধিরা এভাবে বাধা দেবেন কল্পনাও করিনি। এমনটা জানলে সেখানে বিনিয়োগ করতাম না।'
এদিকে কারখানায় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ঘটনার কথা জানতে পেরে বিনিয়োগ ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তামজিদ।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে শিল্প এলাকা সীতাকুণ্ডের জন্য এটি একটি অশনিসংকেত। 'এই চাঁদাবাজি বন্ধ করা না গেলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন,' বলেন এ তরুণ।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য খায়রুল বশরকে ফোন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, 'চেয়ারম্যান এ বিষয়ে অবগত আছেন। তার সঙ্গে কথা বললে বিস্তারিত জানা যাবে।'
জানতে চাইলে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এগুলো এলাকার মানুষের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি — সমাধান হয়ে গেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'নতুন প্রতিষ্ঠানটি কোনোভাবে এলাকার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে রাস্তায় ৩০–৪০ টনের গাড়ি নামিয়েছিল তারা। এজন্য রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পানি চলাচলের ড্রেনেরও একটা সমস্যা দেখা দেয়।'
পরিষদের সদস্য খায়রুল বশরের মুঠোফোনে চাঁদা দাবির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ইউপি সদস্যকে এ কারণে ইতোমধ্যে সতর্ক করা হয়েছে।
তবে ইউপি সদস্যের ফোনালাপ এবং চাঁদাবাজির সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন তিনি
চেয়ারম্যান সাদাকাত উল্লাহ টিবিএসকে কারখানাটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় বলে জানালেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে করা এক পোস্টে তিনি কারখানাটিকে 'তথাকথিত নামবিহীন ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর' বলে উল্লেখ করেন।
জান্নাত পলিটেক্স কারখানার কর্মচারীদের ওপর হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এর জন্য স্থানীয়দের দোষারোপ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড থানার ওসি (তদন্ত) আবু সাইদ বলেন, এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের মালিক ছয়জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
'আমরা একজনকে আটক করেছি। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। এছাড়াও শিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় শিল্প পুলিশ থাকলেও আমরা থানা পুলিশ তৎপর রয়েছি,' ওসি বলেন।