শ্রমশক্তিতে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত: বিশেষজ্ঞ
সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ তৈরি হলেও কাজের সুযোগ একেবারে কম। অটিস্টিকদের কাজের যোগ্য করতে তাদের উপযোগী ট্রেনিং দেয়ার আহবান বিশেষজ্ঞদের। তাহলে একটি নিদিষ্ট বয়সের পর অটিস্টিক ব্যক্তিরা কারো বোঝা না হয়ে তাদের মতো করে বাঁচতে পারে। অটিজমের ধরন অনুযায়ী, যথাযথ ট্রেনিং দিলে অটিস্টিকরাও কাজ করতে পারে বলে জানান চিকিৎসকেরা।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৭২টি স্কুলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে। তবে শিক্ষা সম্পন্নের পর এসব শিশুদের জন্য কাজের সুযোগ কম। শারীরিকভাবে অক্ষম, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকেও মানুষ কাজে নেয় কিন্তু আচরণগত সমস্যা হওয়ায় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাজে নিতে চায় না। তাই তাদের ট্রেনিং দিয়ে যে যেই কাজের উপযোগী, তাকে সেভাবে উপযোগী করে তুলতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সুইড বাংলাদেশের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, "অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের সারাজীবন শিক্ষার্থী বানিয়ে রাখলে তাদের উন্নয়নমূলক সামাজিকীকরণ হবে না, স্বাবলম্বী হতে পারবে না। সরকারের নির্দেশনা আছে ১৮ বছরের পর কাউকে আর বিশেষ স্কুলে রাখা যাবে না। তাদের কাজের জন্য উপযুক্ত করে কাজে নিয়োজিত করতে হবে। মাইল্ড অটিজমে আক্রান্তরা কম্পিউটারের কাজসহ বিভিন্ন ধরণের কাজ করতে পারে। ব্যক্তির চাহিদা এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কার্যক্রমের ভিত্তিতে তাদের দক্ষতা তৈরি করতে হবে।"
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ২৫ বছর বয়সী তারিকুল আলম খন্দকার হিরক রাজধানী ঢাকার সুইড বাংলাদেশ স্কুলে বিশেষ শিক্ষা ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। এখন সুইড ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুলে সেলাই করা, ব্লকের কাজ, কম্পিউটার অপারেটিংসহ বিভিন্ন কাজ শিখছে। পাশাপাশি সুইড বাংলাদেশে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করছে সে। এ কাজ করে নিয়মিত বেতনও পায় হিরক।
হিরকের মতোই সুইড ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুলে ব্লক ও বাটিকের কাজ, সেলাই, কেক ও বিস্কুট তৈরি, কাগজের খাম তৈরি, রান্না করা, কাপড় পরিষ্কার করা, ঘর মোছা, কম্পিউটার অপারেটিং, বিউটি পার্লারের কাজ, নাচ-গান-বাদ্যযন্ত্র বাজানো সহ বিভিন্ন ধরণের কাজ শিখছে ৬০ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু।
সুইড ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাসুদা খানম কনা টিবিএসকে বলেন, "অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা নিজের জগতে থাকে। তাই তাদের দিয়ে কাজ করানো চ্যালেঞ্জিং। তারপরও তাদের কাজ শেখাতে হবে। কারণ তাদের বাবা-মা যখন পৃথিবীতে থাকবে না এ মানুষগুলো যেন তখন নিজেরা কিছু করতে পারে।"
''এখানে ছেলে-মেয়ে সব শিক্ষার্থীদের ঘরের কাজ থেকে শুরু করে কম্পিউটার অপারেটিং-সব শেখানো হয়। এসব শেখানোর জন্য আমরা লক্ষ্য রাখি কার কোন কাজে আগ্রহ বেশি বা কে কোনটাতে ভালো। যে যে কাজটি ভালো পারে সেটি শিখে পরবর্তীতে যেন বাইরে চাকরি করতে পারে। সুইড হয়তো সবাইকে চাকরি দিতে পারবে না তাই অন্য প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে", বলেন মাসুদা খানম কনা।
ডিজঅ্যাবিলিটি ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৭৮,২১২ জন অটিজমে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে ৪৭,৯১৪ জন পুরুষ, ৩০,২৪১ জন নারী এবং ৫৩ জন তৃতীয় লিঙ্গের।
বিএসএমএমইউ'র পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিসঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম ইনস্টিটিউটের ২০১৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রতি ১০ হাজার জনে ১৫ জন শিশু এবং ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার জনে ১৭ জন অটিজমে আক্রান্ত। দুটি জরিপেই মেয়েদের তুলনায় ছেলেশিশুর সংখ্যা বেশি ছিল। একই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহর অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।
বিএসএমএমইউ'র পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ গোপেন কুমার কুন্ডু বলেন, "অটিজম জেনেটিক সমস্যা। এর সাথে পরিবেশগত কারণ যেমন শিশুর একা বড় হওয়া, পরিবেশের হেভি মেটাল এ সমস্যা আরো বাড়িয়ে দেয়। জন্মের ১৮-৩৬ মাসের মধ্যে একটা বাচ্চা যখন অন্য বাচ্চার সাথে মিশে না, অন্য বাচ্চারা যে ধরণের আচরণ করছে তেমন করে না, কথা বলে না- একই কাজ বারবার করে, কোন কিছুর ওপর আসক্তি থাকলে সেটা নিয়ে থাকে সব সময়- এসব লক্ষণ দেখলে ডাক্তার দেখাতে হবে। দ্রুত শনাক্ত (আর্লি ডিটেকশন) করা গেলে অটিজম আক্রান্তদের কাজে লাগানো যায়।"
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অটিজম মনিটরিং সেলের এই পরিচালক বলেন, "আগে মনে করা হতো অটিজম আক্রান্তদের বুদ্ধি নেই। কিন্তু সেটি ঠিক নয়। অটিজম আক্রান্তদের বুদ্ধিমত্তা ভালো থাকে, কিন্তু আচরণগত সমস্যা থাকে। সে কারণে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অটিজমে আর্লি ডিটেকশনের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। যেসব কাজে বুদ্ধির দরকার হয়, সেসব বাদে অন্যান্য যেকোনো কাজ তারা করতে পারে। সেজন্য আর্লি ডিটেকশনে আরো গুরুত্ব দিতে হবে।"
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ রোববার (২ মার্চ) বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে 'রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার জন্য নিউরোবান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব গঠন।'