উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ করছে বিএডিসি
রাজধানীর গাবতলীর গৈদারটেক এলাকার প্রায় ১১ একর জমিতে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। যদিও এ স্থানটিকে ড্যাপে উন্মুক্ত জলাশয় দেখানো হয়েছে।
এ জলাশয়ের পাশে বড় একটি এলাকা জুড়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ঢাকায় জমা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য জলকেন্দ্রিক ইকোপার্কের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। যেখানে বিএডিসি'র এ উন্মুক্ত জলাশয়কেও প্রকল্প এলাকা হিসেবে ধরা হয়েছে। যার জন্য কাজের শুরুতে বিএডিসি বরাবর চিঠিও দিয়েছে উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
বিএডিসি বলছে, তাদের এ জায়গা অনেক আগ থেকেই খামার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে যেখানে তারা বীজ উৎপাদন করছে। এখন বীজ উৎপাদনের জন্য একটির আধুনিক গবেষণাগার তৈরী করার লক্ষ্যে এ জায়গা ভরাট করেছে, এমনটাই বলছেন তারা।
রাজধানী ঢাকাতে একদিকে উন্মুক্ত জলাশয়ের অভাব, আবার যেটুকু আছে তা সরকারি সংস্থাই ভরাট করায় বিষয়টিকে অন্যায় বলছেন পরিবেশবাদীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সংস্থা এমন কাজের জন্য জলাধার আইন লঙ্ঘন করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তারা মনে করছেন।
এরই মধ্যে জলাশয় ভরাট না করতে বিএডিসি এর চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। তবে বিএডিসি বলছে তারা কোনো চিঠি পায়নি।
বিএডিসির চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ সাজ্জাদ বলেন, "আমি দুই মাস আগে জয়েন করেছি। তখনই এ জায়গা ভরাট করা ছিল। এ জায়গা আগে থেকেই আমাদের বীজ উৎপাদন খামার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এখন নতুন করে একটি ভবন তৈরী করে গবেষণাগারসহ বড় আকারে ল্যাব তৈরীর কাজ চলছে।"
ড্যাপে উন্মুক্ত জায়গা দেখানো হলেও সেখানে কেন ভরাট করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "এটি একটি প্রতিষ্ঠিত খামার। এখন ড্যাপে কী দেখানো আছে সেটি আমার নলেজে নেই। সিটি কর্পোরেশনের কোনো চিঠির বিষয় আমার নলেজে নেই।"
পরিবেশ অধিদপ্তর ও রাজউকের অনুমতি নিয়ে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "এই মুহুর্তে আমি বিষয়টি বলতে পারবো না। আমি সারা বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করি। একটিমাত্র বিষয় সম্পর্কে বলতে পারবো না।"
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষি জমি, জলাশয় ভরাটের বিরুদ্ধে কথা বলেন সেখানে সরকারি সংস্থা নিজেই যখন এমন কাজ করে, তা আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমরা রিটেনশন পন্ড নিয়ে পরিকল্পনা করে কাজ করে যাচ্ছি ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ জলাধার ভরাট করলে আমাদের কার্যক্রম ব্যহত হবে। আমরা এ স্থান সংরক্ষণের জন্য অনেক আগেও একবার চিঠি দিয়েছি বিএসডিসিকে।"
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা'র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, "এ জলাশয়টি বিএডিসি নিয়েছিল পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কিন্তু এখন তারা সেটিকে ভরাট করে জলাধার আইন অমান্য করছে। ঢাকা শহরকে নগর বন্যা থেকে রক্ষা করতে উত্তর সিটি কাজ শুরু করেছে, এ বিষয়টি দেখে বিএডিসি ভরাট শুরু করেছে যা অন্যায়। সোজাসাপ্টা কথা, এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।"
তিনি আরও বলেন, "কল্যাণপুরের রিটেনশন পন্ডের এ এলাকা ঘিরে জলকেন্দ্রিক ইকোপার্ক হবে, যেখানে প্রকৃতি নির্ভরতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানী এবং নিজের উৎস থেকে পানি সরবরাহ করে, একটি যুবকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরী করা হয়েছে। এখন যদি জলাধার ভরাট করা হয় তবে তারা নিজেরাও নগর বন্যা থেকে রক্ষা পাবে না।"
গাবতলীর গৈদারটেক এলাকার বিএডিসি'র উন্মুক্ত জলাশয় এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ৩৩ একর খোলা জলাশয়ের প্রায় ১১ একর জায়গায় বালু ও মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। যার এক পাশে একটি অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এক অংশে স্কেভেটর দিয়ে মাটি আলগা করে সমান করা হচ্ছিল।
এখানে কর্মরত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এখানে বালু ফেলে ভরাটের কাজ পেয়েছি তাই ভরাট করেছি। যতোদূর জানি এখানে বিএডিসি'র একটি ৬ তলা ভবন নির্মাণ হবে এবং বাকি অংশে নার্সারি হবে।"
এখানে বিএডিসি থেকে দায়িত্বে থাকা আবু সুফিয়ান নামে এক কর্মচারী বলেন, "প্রায় ৬ মাস আগে এখানে বালু ফেলা শুরু হয়েছে। বিএডিসি এর গবেষণার জন্য এখানে ছয়তলা বিল্ডিংয়ে ল্যাব তৈরী করা হবে। যেখানে টিস্যু কালচার ল্যাব তৈরী হবে। এ প্রজেক্টে বিভিন্ন ধরনের বিদেশি জাতের খেজুর, আনারস, আলু, কলাসহ নানা জাত নিয়ে গবেষণা হবে।"
তিনি আরও বলেন, এখানে গত মৌসুমেও ধান চাষ হয়েছে। উন্মুক্ত জলাধারের ৩৩ একর জমির মধ্যে ১১ একরে বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। বাকি অংশে ধান চাষ হচ্ছে।
এ এলাকায় নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জনস্বার্থে কল্যাণপুর রেগুলেটিং পন্ড সংলগ্ন বিএডিসি'র এ জমিতে ভারী স্থাপনা নির্মাণ না করা সহ ড্যাপের নীতিমালা অনুযায়ী পানি সংরক্ষণাগার হিসেবে বজায় রাখতে গত ২৯ মার্চ বিএডিসির চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে বলা হয়, "বিএডিসির জমিতে ভারী স্থাপনা নির্মাণ করা হলে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ডিএনসিসি কর্তৃক গৃহিত রেগুলেটিং পন্ডের চলমান উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি হবে। নগরীরর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জনস্বার্থে কল্যাণপুর রেগুলেটিং পন্ড সংলগ্ন বিএডিসি'র প্রায় ১১৭ একর জায়গায় ভারী স্থাপনা নির্মাণ হতে বিরত থাকা প্রয়োজন।"
উল্লেখ্য, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকা ওয়াসা থেকে কল্যাণপুর রেগুলেটিং পন্ডের প্রায় ৫৩ একর জায়গা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নিকট হস্তান্তর করা হয়। ফলে সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় ১০৫ একর জমি রয়েছে। যেখানে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে নগরীর সকল খালসহ রেগুলেটিং পন্ডের উন্নয়নমূলক কাজ করছে ঢাকা উত্তর।
গাবতলী বেড়িবাঁধ ও কল্যাণপুর রেগুলেটিং পন্ডসংলগ্ন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) প্রায় ১১৭ একর জায়গা রয়েছে, যা ড্যাপ এর নকশা অনুসারে ওয়াটার বডির আওতাভুক্ত রয়েছে। ওয়াটার বডির আওতাভুক্ত ভূমিতে রাজউক কর্তৃক ছাড়পত্র গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এসব ওয়াটার বডিকে ঘিরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি জলকেন্দ্রিক ইকোপার্ক গড়ে তোলার কাজ চলমান রয়েছে।
কল্যাণপুরের খালগুলো রক্ষার্থে এবং এর প্রবাহ ও পানি নিষ্কাশন ঠিক রাখতে প্রায় ১৮২.৩১ একর জুড়ে হবে এ জলকেন্দ্রিক ইকোপার্ক।