তীব্র তাপদাহের প্রভাব হালদায়, সংকটে মা মাছ
তীব্র তাপদাহে বিপর্যন্ত সারাদেশের জনজীবন; যার প্রভাব পড়েছে প্রকৃতিতেও। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা ও লবণাক্ততার কারণে অনুকূল সময়েও (মার্চ-জুলাই) প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদায় ডিম ছাড়ছেনা মা মাছ।
প্রাণি বিজ্ঞানীরা বলছেন, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে হালদার ডিমে পরিপূর্ণ মা-মাছের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনজনিত হুমকি সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে নদীর বাস্তুসংস্থান।
প্রতি বছরের চৈত্র থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যে পূর্ণিমা-অমাবস্যার তিথিতে বজ্রসহ বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নামে হালদা নদীতে। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা 'জো' বলে। এই জো এর সময় প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের ফলে হালদা নদীর বাঁকগুলোতে পানি ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়।
এসময় নদীর বাঁকে ভৌত-রাসায়নিক ফ্যাক্টর সৃষ্টি হলে ও তাপমাত্রা অনুকূলে ২৫-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছর গুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কমছে বৃষ্টিপাত, বাড়ছে তাপমাত্রা। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে হালদায় বাড়ছে লবণাক্ততাও। ফলে হালদায় কার্প জাতীয় মা মাছের সংকট স্থায়ী হচ্ছে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ইতোমধ্যে একটি জো চলে গেছে, বর্তমানে একটি জো চলছে। কিন্তু পানির উষ্ণতা স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি। এই কারণে নদীতে ভৌত-রাসায়নিক ফ্যাক্টরগুলো সৃষ্টি হচ্ছেনা। ফলে মা মাছ ডিম ছাড়ছেনা।'
তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামে বর্তমানে স্বাভাবিকের চাইতে ৪ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করছে। নদীর পানিতে সরাসরি প্রভাব পড়ছে এর। যেহেতু মা-মাছ গুলো ডিমে পরিপুর্ণ, তাই তাদের তাপমাত্রা সহ্য ক্ষমতা কমে গেছে।'
'এ অবস্থা চলমান থাকলে মা-মাছের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন দেখা দেবে। পাশাপাশি ওয়াটার কোয়লিটি পরিবর্তন হয়ে নষ্ট হবে নদীর বাস্তুসংস্থান,' বলেন তিনি।
হালদা নদীর দুই তীরে রিটার্নিং ওয়াল তৈরী ও ব্লক ফেলার কারণে নদীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে নদীর পানির তাপমাত্রা আরও বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও দাবি করেন অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া।
এছাড়া কয়েক বছর ধরে হালদায় লবণাক্ততাও মা-মাছের জন্য একটি বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, কাপ্তাই লেকের পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় জোয়ারের সঙ্গে সাগরের লোনা জল প্রবেশ করছে কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে। ওয়াসার মোহরা প্রকল্পে সর্বোচ্চ ১৭০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণ মিলেছে প্রতি লিটার পানিতে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কর্ণফূলিতে উপর থেকে নেমে আসা পানির চাপ কম থাকায় সাগরের পানি ঢুকছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী প্রতি লিটার পানিতে ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ মিলিগ্রাম লবণ থাকলে তা পান করা যায়। ওয়াসার মোহরা প্রকল্পের নদীর পানিতে ১৭০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণ পাওয়া গেছে।'
৪০ বছর ধরে হালদায় ডিম সংগ্রহ করছেন উত্তর মাদার্শা এলাকার জেলে আশু জলদাশ। তিনি বলেন, 'নদীর পানিতে যে গরম আর লবণ, এ অবস্থায় মা-মাছ ডিম ছাড়বেনা। তবে নৌকা, জাল, বড় পাতিলসহ ডিম ধরার বিভিন্ন সরঞ্জামও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বৃষ্টি হলেই হয়তো মাছ ডিম ছাড়বে।'
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড.মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানান, কার্পজাতীয় মাছ ২২-৩০ ডিগ্রী পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। এর চাইতে বেশি তাপমাত্রা কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন আচরণে পরিবর্তন আনবে। যেমন-প্রজনন সময় পিছিয়ে যাওয়া, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, ডিম্বাণুর পূর্ণতা প্রাপ্তিতে দেরি, এবং হরমোনের ভারসাম্যহীতা তৈরী হয়ে ডিম উৎপাদন কমে যাওয়া।
ড.মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, 'উচ্চ তাপমাত্রা নদীর বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য শৃঙ্খলকেও প্রভাবিত করতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রার প্রতি সংবেদনশীল অনেক জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণী মারা যেতে পারে। ফলে কার্প জাতীয় মাছের খাদ্য উৎস কমে তাদের বৃদ্ধির হার এবং সামগ্রিক নদীর বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে।'
'এছাড়াও উচ্চ তাপমাত্রায় মাছের বিপাকীয় হার বৃদ্ধির ফলে অক্সিজেনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পেয়ে শ্বসন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে প্রজননের পরিমাণই কমে আসতে পারে,' বলেন তিনি।
হালদার গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী বলেন, 'মা মাছ ডিম দেওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। তবে উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় তারা ডিম ছাড়ছেনা। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের ফলে হালদা নদীতে ঢল নামে। নদীতে পানির তীব্র স্রোত সৃষ্টি করে পানির তাপমাত্রা ২৭–২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে ১৪–১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকলে ডিম তা দেয়ার উপযোগী হয়।'
পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে হালদায় ২ মে থেকে ৮ মে, ১৬ থেকে ২২ মে, ১ থেকে ৬ জুন, ১৬ থেকে ১৯ জুন যে কোনো একটিতে মা-মাছ ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী।
২০২০ সালে রুই জাতীয় মাছের মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।