সৌদি আরবে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেবে না বাংলাদেশ
সৌদি আরবে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদেরকে পাসপোর্ট দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্র(এনআইডি) ধারী ব্যক্তি এবং যাদের এনআইডি নেই, কিন্তু বৈধ পাসপোর্ট, জন্ম নিবন্ধন বা বাংলাদেশে পরিবার ও স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণ আছে, তাদেরই পাসপোর্ট নবায়ন বা ইস্যু করার সুযোগ দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে সৌদি আরবে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠানোর জন্য বিশেষ পাসপোর্ট প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সহায়তা করতে পারে।
এ নিয়ে আলোচনা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আগামী সপ্তাহে সৌদি আরব যাচ্ছেন।
গত বছর নভেম্বরে সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী নাসের বিন আব্দুল আজিজ আল দাউদ ঢাকায় এসে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়া নিয়ে বৈঠক করেন। সৌদি আরবের দাবি, তাদের দেশে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে। এদের অনেকের কাছেই মেয়াদোত্তীর্ণ বাংলাদেশি পাসপোর্টও রয়েছে। সেসব লোকেদের বৈধ অবস্থান নিশ্চিত করতে সৌদি আরব পাসপোর্ট ইস্যু বা নবায়ন চায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদিতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট না দেওয়ার সিদ্ধান্তই ঠিক আছে। তবে সেটি করতে হবে সৌদি সরকারকে সঙ্গে নিয়ে। কারণ সৌদি আরব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রম বাজার। প্রায় ২৮ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক দেশটিতে কাজ করছেন।
সৌদি আরবে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, সৌদি আরব বলছে তাদের দেশে অবস্থানরত বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে। তাদের কাছে বাংলাদেশি পাসপোর্টও ছিল। কিন্তু সেসব রোহিঙ্গারা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশি নয়। ওআইসির সমঝোতায় বিশেষ ব্যবস্থায় তাদেরকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, "কিন্তু এসব রোহিঙ্গারা এখন স্টেটলেস হয়ে পড়েছে। তাদের কোনো বৈধ পাসপোর্ট নেই। রোহিঙ্গাদের সন্তানরা লেখাপড়া বা ব্যবসার কাজে অন্য দেশে যেতে পারছে না। আবার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্টেটলেস জনগণকে কোনো রাষ্ট্র ধারণ করতে পারে না। এতদিন সৌদি আবর বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি; এখন দিচ্ছে। যে কারণে সৌদি আরব এসব জনগণের পাসপোর্ট নবায়ন বা ইস্যুর বিষয়ে জোর দিয়েছে।"
"তবে 'পাসপোর্ট নিতে বা নবায়ন করতে নিজেকে বাংলাদেশি প্রমাণ করার' যে নীতি সরকার নিয়েছে সেটিকে আমি সঠিক বলে মনে করি," যোগ করেন তিনি।
সৌদি আরব কেন রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট বাংলাদেশ থেকে চাচ্ছে?
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সাল সময়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়ে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সেই সময় ওআইসি মধ্যস্থতা করে এসব রোহিঙ্গাদের সৌদি আরবে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। সেইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে অনুরোধ করে ওআইসি ও সৌদি আরব। বাংলাদেশ প্রায় আড়াই লাখ রোঙ্গিকাকে পাসপোর্ট দেয়। পাকিস্তানও সমপরিমাণ রোহিঙ্গার নামে পাসপোর্ট ইস্যু করে।
পাকিস্তানের পাসপোর্টে তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে বিআর(বার্মিজ রোহিঙ্গা) উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তান সেইভাবে পাসপোর্ট নবায়নও করে। ফলে তাদের পরিচয় নিয়ে সমস্যা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পাসপোর্টে তা করা হয়নি। যে কারণে বর্তমান সমস্যা তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, এর আগেও সৌদি আরব এসব রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন বা ইস্যু করার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছে। ২০১০ সালে এ বিষয়ে প্রথম আলোচনা তোলে সৌদি আরব। এরপর ২০১৯ সাল থেকে এক ধরনের চাপ প্রয়োগ করে আসছে দেশটি।
করোনার আগে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গার কাগজপত্র দিয়ে তাদের পাসপোর্ট দেওয়ার কথা বলেছিল সৌদি আরব। পরে আরও ২৪ হাজার রোহিঙ্গার নথিপত্র বাংলাদেশকে দিয়েছে তারা।
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে যেসব রোহিঙ্গা সৌদি আরব গেছেন, তাদেরকে পরে এক ধরনের আইডি কার্ড দিয়েছে সৌদি সরকার। সেখানে সেসব লোকদের মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশ এখন তাদেরকে পাসপোর্ট দেওয়ার যৌক্তিকতা দেখছে না।
সূত্র জানায়, সৌদি আরবে অবস্থানরত যেসব বাংলাদেশির পাসপোর্ট নেই বা পাসপোর্টের মেয়াদ নেই, তাদেরকে পাসপোর্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে যিনি পাসপোর্ট ইস্যু বা নবায়নের আবেদন করবেন, তাকে অবশ্যই নিজেকে বাংলাদেশি প্রমাণ করতে হবে। এ বিষয়ে আলোচনা করতেই সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল সৌদি আরব যাচ্ছে। প্রয়োজনে দুই দেশ যৌথভাবে যাচাই বাছাইয়ের কাজ করবে।
রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে একক দেশ হিসেবে সৌদি আরব বাংলাদেশের বৃহত্তম উৎস। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশটি থেকে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৪৫১ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। চলতি অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশি প্রবাসীরা ২৪৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।