যে কারণে বারবার নিলামে তুলেও বিক্রি হয় না কাস্টমসের পণ্য
২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে একটি রাইস মিল মেশিন আমদানি হয়েছিল। বর্তমানে বন্দরের এন শেডে পড়ে আছে প্রায় ৩৮ হাজার টাকা মূল্যের মেশিনটি। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চার বছরে অন্তত ২০ বার নিলামে তোলা হয়েছিল এই পণ্যটি। এরপরেও বিক্রি করা যায় নি।
২০১৮ সালে চীন থেকে ৫ লাখ ৮৬ হাজার টাকা দামের ৩৬টি এলিভেটর স্পেয়ার পার্টস (খুচরা যন্ত্রাংশ) আমদানি করা হয়। ২০২১ সাল থেকে এসব খুচরা যন্ত্রাংশ নিলামে তোলা হয়েছিল চারবার। এরপরও বিক্রি হয়নি।
২০১৯ সালে ছয় ইউনিট এয়ার কন্ডিশনার (এসি) আমদানি হয়েছিল। ৬ লাখ ৭ হাজার টাকা মূল্যের পণ্য চালানটি বর্তমানে বন্দরের সিসিটি ইয়ার্ডে পড়ে আছে। এসব এসির চাহিদা থাকার পরও গত বছর থেকে দুই বার নিলামে তুলেও বিক্রি করা সম্ভব হয়নি।
বারবার নিলামে তুলেও অনেক পণ্য বিক্রি করতে পারছে না চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। পণ্যের গুণগত মানের চেয়ে তুলনামূলক দাম বেশি নির্ধারণ করা, কাস্টমসের নিয়মানুযায়ী নির্ধারিত দামে বিক্রিসহ নানা কারণে এসব পণ্য বিক্রি করতে পারছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে বছরের পর বছর দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের শেডগুলোর জায়গা দখল হয়ে আছে। পাশাপাশি পণ্যগুলো দীর্ঘদিন পড়ে থেকে অকেজো বা বিকল হয়ে যাচ্ছে। বারবার নিলাম আয়োজন করার কারণে গচ্চা যাচ্ছে সরকারি অর্থ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাধারণত শুল্ক ফাঁকি, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শুল্ক পরিশোধ না করা, সময়মতো ছাড় না করার কারণে পণ্যগুলো নিজেদের অধীনে নেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। পরে তা নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। পণ্যের আমদানি মূল্যের ওপর ভিত্তি করে সংরক্ষিত মূল্য নির্ধারণ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কাস্টমসের নিয়মানুযায়ী সংরক্ষিত মূল্যের নূন্যতম ৬০ শতাংশ দামে বিক্রি করতে হয়।
গত ১৬ এপ্রিল থেকে ৭ মে পর্যন্ত সর্বশেষ নিলামের দরপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। এবার ৭৬টি লটে পণ্য নিলামে তোলা হয়েছে। মোট ২৭৫টি দরপত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিলাসবহুল গাড়ি, খাদ্যসামগ্রী, ভারী যন্ত্রপাতি, মোটর পার্টস, লোহা, স্টিল স্ত্র্যাপ, টেক্সটাইল, ফেব্রিক, গ্লাসওয়ার, পেপার ও প্লাস্টিক পণ্য রয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের তথ্যমতে, নিলামে সংরক্ষিত মূল্যের ৬০ শতাংশের কম দামে বিক্রি না করার বিধান রয়েছে। ফলে অনেকগুলো পণ্য বারবার নিলামে তুলেও বিক্রি করতে পারছে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এছাড়া নিলাম কমিটির সভায় পণ্যের গুণগত মানের ওপর ভিত্তি করে দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে। এজন্য বিডাররা (দরদাতারা) সিন্ডিকেট হয়ে পণ্য না কিনে দাম কমানোর অভিযোগও রয়েছে।
নিলামে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিয়মানুযায়ী প্রথম দরপত্রের যদি কোন পণ্যের দাম ৬০ শতাংশ না উঠে তবে তা অনুমোদন হবে না। দ্বিতীয় নিলামে যদি প্রথম দরপত্রের চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যায়, তবে বিক্রির সুযোগ রয়েছে। এরপর তৃতীয়, চতুর্থ বা পর্যায়ক্রমে পরের দরপত্রে দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব নিয়ম মানা হয় না। কারণ বিধান অনুযায়ী, এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা মূল্য নির্ধারণ করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে নিলাম কমিটিকে। এই বিধানকে ব্যবহার করে তারা পণ্যের দাম কমায় না। তাই পণ্যগুলো বারবার নিলামে তুলেও ক্রেতা পাওয়া যায় না।
চট্টগ্রাম কাস্টমস নিলাম ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াকুব চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পণ্যের গুণগত মান অনুযায়ী সংরক্ষিত মূল্য অনেক বেশি থাকে। এ কারণে ক্রেতারা আগ্রহী থাকেন না। কারণ ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য ব্যবহারের জন্য কেনেন না। তারা বিক্রির জন্য কেনেন। কেউ তো লোকসানের উদ্দেশ্যে কেনেন না। কাস্টমসের নিয়ামকানুনের কারণে অনেকবার নিলামে তুলেও পণ্য বিক্রি হয় না। এরপর শেডে পড়ে থাকতে থাকতে, গুণগত মান দিন দিন আরও খারাপ হয়।"
কাস্টমস কর্মকর্তাদের বলছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সকল কার্যক্রম সফটওয়্যার অ্যাসাইকুডার মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। এই সফটওয়্যারে নিলামের সিস্টেম থাকলেও এখনো চালু করা হয়নি। এজন্য এখনো ম্যান্যুয়াল পদ্ধতিতে নিলাম সম্পাদিত হয়। ফলে নিলামের তথ্যগুলো গোছানো অনেক কঠিন। অনেক কাগজপত্র ঘেঁটে পণ্যের নিলাম সংক্রান্ত তথ্য বের করতে হয়। তাই নিলাম শাখায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের- শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এ কারণে তারা কাজ করতে চান না। এছাড়া দেখা যায়, কিছু বিডার ডিও'র মাধ্যমে পণ্য বুকড দিয়ে পাওনা পরিশোধ করেন না। তারা এসব পণ্য ক্রেতাদের দেখিয়ে ক্রেতা ঠিক করেন। এরপর পণ্যের মূল্য পরিশোধ করেন। এক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক অনুরোধ থাকে পণ্য ধরে রাখার জন্য।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার (নিলাম শাখা) মো. নাহিদুন্নবী টিবিএস বলেন, "নিলাম প্রক্রিয়াটি অনলাইন করার বিকল্প নেই। ক'দিন আগে কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখি, একটি চালানের মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু এটি নিলামে তোলা হয়নি। অনলাইন কার্যক্রম পরিচালিত হলে সহজে সব তথ্য পাওয়া যেত।"
"মামলার কারণে দীর্ঘদিন পণ্য শেডে থেকে নষ্ট হয়ে যায়। এটিও একটি কারণ। তবে মামলা থাকলেও নিলাম করা যায়। এছাড়া পণ্যের গুণগত মান খারাপ হলে তা আবার শুল্কায়ন শাখায় ভ্যাল্যু যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয়। তখন তা দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি করে। এসব কারণে মূলত নিলাম প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন করা কঠিন", যোগ করেন এ কাস্টমস কর্মকর্তা।