বিপুল সংখ্যক বিদেশি বিনিয়োগকারী স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে মামলায় জড়িয়ে পড়েছে
দেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী বিদেশি কোম্পানি এবং তাদের স্থানীয় অংশীদার বা স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ বাড়ছে। চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট ও বিচারিক আদালতে এরকম প্রায় ৩,০০০ হাজার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
এসব মামলার সঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিরোধ জড়িত। এই মামলাগুলোর মধ্যে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে প্রায় ১,২০০ মামলা ও আপিল রয়েছে। বিচারিক আদালতে রয়েছে প্রায় ১,৮০০ মামলা। কিছু মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে।
এক কোম্পানির সঙ্গে অন্য কোম্পানির বা কোম্পানির সঙ্গে ব্যক্তির বিরোধ, আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিরোধ, প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হস্তান্তর, মালিকানা, চুক্তি লঙ্ঘন, প্রতারণা, বিনিয়োগ, মানহীন পণ্য সরবরাহ ইত্যাদি নানান বিষয়ের বিরোধ থেকে এসব মামলা করা হয়েছে।
পুরনো মামলা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে বিদেশি কোম্পানি-সংক্রান্ত মামলাও।
সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইংয়ের তথ্য অনুসারে, শুধু চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকেই এ ধরনের ১১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর ২০২২ সালে এ ধরনের ৪২৭টি, ২০২১ সালে ৩৭৪টি, ২০২০ সালে ২৫৬টি ও ২০১৯ সালে ১৮৬টি মামলা হয়।
বিশেষজ্ঞ ও আদালতের সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিচারক ও আদালত সংকটে সারা দেশের আদালতগুলোতে প্রায় ৪০ লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এরমধ্যে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে বিরোধ-সংক্রান্ত মামলা পরিচালনায় নেই পৃথক কোনো আদালত।
এছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি (এডিআর) বাস্তবায়ন না হওয়া ও মামলা পরিচালনার মতো দক্ষ আইনজীবীর অভাবেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোম্পানী আইন, ১৯৯৪-এর অধীনে করা এসব মামলা সমাধানে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতে এসব বিরোধ সমাধানে দীর্ঘসূত্রিতার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট ও ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আসার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। এছাড়া মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হওয়ার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে, একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আর্থিক বোঝা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে।
ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সৈয়েদ্যুর রহমান রানু বলেন, মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই)।
তিনি বলেন, 'সমকক্ষ অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এফডিআই প্রবাহ সাধারণত বেশ কমই হয়। এদেশে বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে অনেক বেশি সময় লাগাটা এর অন্যতম এক কারণ।'
ব্যবসায়িক বিরোধ-সংক্রান্ত মামলা দায়েরের হার নিষ্পত্তির হারের চেয়ে বেশি—সেটি বিদেশি কোম্পানি-সংক্রান্ত হোক বা না হোক—এই তথ্য থেকেই দুর্বল বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইংয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে ৭,৩০৯টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়, বিপরীতে মামলা দায়ের হয় প্রায় ২৯ হাজার।
এর আগের বছরে ৬,৭৫০টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়, মামলা দায়ের হয় প্রায় ২৩ হাজার। ২০২০ সালে এর আগের বছরে ৪,৮০০টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়, মামলা দায়ের হয় প্রায় ১৭ হাজার।
বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের সহজে ব্যবসা করার সূচকে (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স) চুক্তি কার্যকরের দিক থেকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯তম। এই সূচকটি বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি ও তার বিচারিক প্রক্রিয়ার মান, সময় ও ব্যয়কে নির্দেশ করে।
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা মামলা
১৯৯৮ সালে বেলজিয়ামভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ক্যাপজেমিনি বাংলাদেশে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় অংশীদার লেয়ডবিডি লিমিটেডের সঙ্গে বিনিয়োগ করে। তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগ ছিল প্রায় ৩২ কোটি টাকা। বিনিয়োগের কিছুদিন পরই স্থানীয় সহযোগীর সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয় ক্যাপজেমিনির।
এরপর ২০০০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার যৌথ জেলা জজ আদালত-৫-এ মামলা করে বিদেশি কোম্পানিটি।
বিদেশি কোম্পানিটির অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার শাহ মোহাম্মদ আহসানুর রহমান বলেন, ২০১১ সালে বিচারিক আদালত তার মক্কেলের পক্ষে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে তখন হাইকোর্টে আপিল করে বাংলাদেশের কোম্পানি। হাইকোর্ট ২০১৪ সালে বিচারিক আদালতের রায় বহাল রাখেন। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা হলেও এখন পর্যন্ত তার নিষ্পত্তি হয়নি।
ঢাকার কেরানীগঞ্জে তোসিয়ানা শিংগসু নামক একটি কোরিয়ান কোম্পানি মোটরকারের জন্য চামড়ার সিট কভার প্রস্তুত করে। ২০১৩ সালে কাঁচা চামড়া কিনতে তারা ৫০ কোটি টাকা অগ্রিম দেয় হাজারীবাগের কোম্পানি এনাম ট্রেডার্সকে।
কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী, কাঁচামাল সরবরাহে ব্যর্থ হয় এনাম ট্রেডার্স। অগ্রিম টাকা তারা পরে ফেরতও দেয়নি।
এমতাবস্থায় ২০১৪ সালে ঢাকার একটি আদালতে অর্থ আদায়ের জন্য মামলা করে বিদেশি কোম্পানিটি ।
তোসিয়ানা শিংগসুর পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার এ এস এম শাহরিয়ার কবির বলেন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। আইনিভাবে সুরাহা না মেলায় বিদেশি কোম্পানিটি বাংলাদেশে আর বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বন্ধ করে তারা।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব উল-আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কোম্পানি আইনে স্পষ্ট বলা আছে, প্রতিটি জেলায় কোম্পানি-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। প্রতিটি বিভাগে অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল করতে হবে।
এছাড়াও এই আইনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি (এডিআর) বাধ্যতামূলক করার বিধান রয়েছে। 'কিন্তু বাংলাদেশে এগুলো কিছুই নেই। ফলে যেসব বিরোধ তৈরি হচ্ছে, সেগুলো নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণ হচ্ছে,' বলেন ইনি।
এছাড়াও হাইকোর্ট বিভাগে একটি মাত্র বেঞ্চ রয়েছে কোম্পানি মামলার বিচারের জন্য। পৃথক আরো চারটি বেঞ্চ করা উচিত বলে মনে করেন এই আইন বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসীম উদ্দিন বলেন, দেশের বেশিরভাগ কোম্পানি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগভিত্তিক। দেশের বেশিরভাগ বাণিজ্য পরিচালিত হয় এই দুই বিভাগকে কেন্দ্র করে। ফলে এসব এলাকায় ব্যবসা-সংক্রান্ত বিরোধও বেশি।
চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশের আদালতগুলোতে দেশি-বিদেশি কোম্পানির বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিরোধের প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার ৮২৩টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এসব মামলার সঙ্গে প্রায় ২.৫ লাখ কোটি টাকার বিরোধ জড়িত। এর মধ্যে বিচারিক আদালতগুলোতে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৮২৩টি এবং সুপ্রিম কোর্টে ৩৪ হাজার মামলা রয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইংয়ের তথ্যমতে, গত মার্চ মাস পর্যন্ত দেশের বিচারিক আদালতগুলোতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা বাণিজ্য বিরোধ-সংক্রান্ত মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ২ হাজার ২০৮টি মামলা রয়েছে ঢাকা বিভাগে। চট্টগ্রাম বিভাগে রয়েছে ৬৯ হাজার ৬০০টি।
বিকল্প নেই এডিআরের
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আজমালুল হক কেসি বলেন, বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উন্নত দেশগুলোয় আদালতের বাইরে সালিশের মাধ্যমে অলটারনেটিভ ডিসপিউট রেগুলেশন (এডিআর) প্রয়োগ বাধ্যতামূলক।
এডিআরের সাধারণ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে—মধ্যস্থতা, সালিশ ও নিরপেক্ষ পর্যালোচনা। সাধারণত এসব প্রক্রিয়া গোপনীয়তার সঙ্গে তবে কম আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরসহ প্রায় ৮০টি দেশ এখন এডিআর প্রয়োগ করে বিরোধ নিষ্পত্তি করা বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি হয়নি বলে জানান আজমালুল হক।
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠন ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এডিআর প্রয়োগে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুই-একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও, সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
নতুন কোনো আইনি কাঠামো আছে?
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি টিবিএসকে বলেন, এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কয়েকবার সভা হয়েছে। সে অনুসারে, এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে তাদের উদ্যোগ নেওয়ার কথা।
তিনি জানান, সরকার ব্যবসা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য এডিআর-এর বিধান-সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়নের চিন্তা করছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এসব বিরোধ ও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আদালতগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত তিন বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আর বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি-সংক্রান্ত একটি নতুন আইন প্রণয়নের কাজ চলছে।
বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০১৮ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়কে একটি নীতি তৈরির অনুরোধ জানায়।
আইন মন্ত্রণালয় তখন বাংলাদেশ আইন কমিশনকে এ বিষয়ে একটি খসড়া আইন প্রণয়নের অনুরোধ করে। সে অনুযায়ী কমিশন 'বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি আইন' নামে একটি একটি খসড়াও প্রস্তুত করেছে।
মূলত সালিশি আইন-২০০০ সংশোধন করে এই খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানান আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
বাংলাদেশে আদালতের বাইরে সালিশি কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রচলিত বিচারব্যবস্থার পদ্ধতিগত জটিলতা পরিহার এবং দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি এর মূল্য লক্ষ্য বলে জানান তিনি।
আইনটি প্রণীত হলে বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির গতি বাড়বে বলেও উল্লেখ করেন এবিএম খায়রুল হক।