গুরুত্বপূর্ণ চার যন্ত্র বিকল চমেক হাসপাতালে, দুর্ভোগে রোগীরা
নারীদের জরায়ু ক্যানসারের চিকিৎসা দেয়া হয় ব্র্যাকিথেরাপির মাধ্যমে। রাজধানী ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে রয়েছে এই যন্ত্রটি। কিন্তু গত বছরের জুন মাস থেকে যন্ত্রটি বিকল হয়ে পড়ে আছে। ফলে বিপাকে পড়ছেন নারী রোগীরা।
নারীদের স্তনে টিউমার বা ক্যানসার নির্ণয়ের পরীক্ষায় ব্যবহৃত চমেক হাসপাতালের ম্যামোগ্রাফি যন্ত্রটিও এক বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। সরকারি হাসপাতালের ৮০০ টাকার পরীক্ষাটি করতে বেসরকারিতে ব্যয় হয় প্রায় ২০০০-৩০০০ টাকা। যন্ত্রটি সচল না হওয়ায় বিপাকে পড়ছেন আর্থিক অস্বচ্ছল রোগীরা।
শুধু ব্র্যাকিথেরাপি বা ম্যামোগ্রাফি যন্ত্র নয়, চমেক হাসপাতালের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা ও পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ চারটি যন্ত্র বিকল। কোনটি চার বছর আবার কোনটি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে না। ফলে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। বেশি খরচে বেসরকারি হাসপাতাল বা ডায়গনস্টিক সেন্টারের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) কর্তৃপক্ষের কাছে চমেক হাসপাতালের পক্ষ থেকে একাধিক বার চিঠি পাঠালেও সাড়া মিলছে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পাশাপাশি চুক্তি অনুসারে চিকিৎসাযন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেরামতের কাজ না করা এবং বকেয়া বিল বাকি থাকায় বিকল যন্ত্রগুলো মেরামত হচ্ছে না। এছাড়া উচ্চ প্রযুক্তির চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সার্বক্ষণিক চালু রাখার জন্য ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের একটি নির্দেশিকা (গাইডলাইন বা সিএমসি) মানতে চাইছে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।
চমেক হাসপাতালের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জার্মানি থেকে আমদানি করা ব্র্যাকিথেরাপি যন্ত্র স্থাপন করা হয় হাসপাতালে। জরায়ুসহ কয়েকটি ক্যানসারের জন্য ব্র্যাকিথেরাপি দরকার হয়। গত বছরের ৬ জুন যন্ত্রটি অনুপযোগী হয়ে পড়ে। পরে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা বিকল যন্ত্রটি নিরীক্ষা করে, কিছু খুচরা যন্ত্রাংশ পরিবর্তনের সুপারিশ করে। কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) একটি প্যাকেজে সারা দেশের জন্য ৫টি যন্ত্র কেনার পরিকল্পনা করে। এর মধ্যে ৩টি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। যার ৩০ শতাংশ বিল এখনো পরিশোধ করা হয়নি। এজন্য এই চিকিৎসা যন্ত্রটি মেরামত করা হচ্ছে না।
চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের বহির্বিভাগে বছরে ১৮-২০ হাজার রোগী চিকিৎসা সেবা নেন। বছরে ৫-৭ হাজার নতুন রোগী হাসপাতালে আসেন। তাদের বড় অংশের ব্র্যাকিথেরাপি নিতে হয়। ঢাকায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ব্র্যাকিথেরাপি সেবা নিতে প্রতি সেশনে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় হয়, যা সরকারি হাসপাতালে মাত্র দেড় হাজার টাকায় সম্ভব।
যন্ত্র স্থাপনেই গাফিলতি
২০১৬ সালে নিউ টেক জি টি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় দুটি ম্যামোগ্রাফি যন্ত্র সরবরাহের চুক্তি করে সিএমএসডি। এর মধ্যে একটি চমেক হাসপাতালের ছিল। ২০১৭ সালের মার্চে যন্ত্রটি চমেক হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের একটি কক্ষে খোলামেলা অবস্থায় ফেলে রেখে যায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি শেষে এক বছর ৫ মাস পর ২০১৮ সালে আগস্টে যন্ত্রটি স্থাপন করা হয়।
তবে স্থাপনের পর থেকে কদিন পরপর যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চার বছরে চার দফা নষ্ট হয়েছিল যন্ত্রটি। এই সময়ে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুই বছরের কম সময় চালু ছিল। কিন্তু চুক্তি অনুসারে ওয়ারেন্টি (মেয়াদকাল) ছিল তিন বছর। এরপরও প্রতিষ্ঠানটিকে বারবার অবহিত করলেও যন্ত্রটি সচল করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এই ইস্যুতে অন্তত ২০ দফা চিঠি চালাচালি করেছে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যন্ত্রটি বিকল থাকায় টিউমার-ক্যান্সার পরীক্ষার জন্য বেসরকারি পর্যায়ে অন্তত তিন গুণ ব্যয় করতে হচ্ছে রোগীদের।
সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিউ টেক জি টি লিমিটেডের ম্যানেজার কমল হোসাইন টিবিএসকে বলেন, "এই যন্ত্রটির খুচরা যন্ত্রাংশ জার্মানি থেকে আনতে সময় লাগে। করোনার সময় খুচরা যন্ত্রাংশ আনা সময়সাপেক্ষ ছিল। এজন্য যন্ত্রটি মেরামত করতে সময় লেগেছিল। ওয়ারেন্টির সময় শেষ হয়েছে। তবুও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে এই মাসের শেষদিকে মেরামত করা হবে।"
চার বছর ধরে নষ্ট এমআরআই যন্ত্র
২০১৭ সালের ১৬ আগস্টে ৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে চমেক হাসপাতালের জন্য এমআরআই যন্ত্র স্থাপন করা হয়। তিন বছরের ওয়ারেন্টি শেষ হওয়ার পর ২০২০ সালের শেষের দিকে যন্ত্রটি বিকল হয়ে যায়। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকার মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামত করে। তবে মাস পার না হতেই আবার বিকল হয়ে যায়। ২০২১ সালের মে মাসে একেবারে অকার্যকর হয়ে পড়ে।
চমেক হাসপাতালের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশিকা (গাইডলাইন বা সিএমসি) তৈরি করে। তা অনুসারে সরবরাহের পর প্রথম বছরে যন্ত্রের মূল্যের সাড়ে ৬ শতাংশ হারে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ধরা হয়। সেই হিসাবে যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় দাঁড়ায় ৬৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটি চমেক হাসপাতালের এমআরআই যন্ত্রের ত্রুটি সারাতে সাড়ে ৯৩ লাখ টাকা দাবি করেছে। এই জটিলতা নিয়ে ঝুলে আছে মেরামত প্রক্রিয়া। এই ইস্যুতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অন্তত ২০ বার চিঠি চালাচালি করলেও সুরাহা হয়নি।
সরকারি পর্যায়ে এমআরআই করাতে চার হাজার টাকা ব্যয় হয়। বেসরকারি পর্যায়ে এমআরআইয়ের ব্যয় ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আগে চমেকে প্রতিদিন ২০-২৫টি এমআরআই হতো।
চমেক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি হাসপাতালে দিন-রাত এমআরআই যন্ত্রটি চালু থাকে। কিন্তু চমেক হাসপাতালে তা সারাদিন চালু রাখতে হয় না। এ হিসেবে যন্ত্রটি আরো বেশিদিন চালু থাকার কথা। বেসরকারি হাসপাতালেও অন্তত ১০ বছর চলে যন্ত্রটি।
রোগীদের কাঁধে খরচের বোঝা
হৃদরোগের চিকিৎসায় রিং পড়ানো, এনজিওগ্রাম, পেসমেকার বসানো অনেক ব্যয়বহুল। সরকারি হাসপাতালে হার্টে রিং পড়াতে (স্টেন্টিং) সরকার নির্ধারিত দাম ৭৬ হাজার টাকা ও এনজিওগ্রামের ৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়। অথচ বেসরকারি পর্যায়ে একটি ব্লকের জন্য রিং পড়াতে ব্যয় দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা এবং এনজিওগ্রামে ২০ হাজার টাকা লাগে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এই ভার বহন করতে পারেন না।
চমেক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের দুটি ক্যাথল্যাবের মধ্যে একটি বন্ধ রয়েছে গত দুই বছর। রোগীর চাপে একটি ক্যাথল্যাব দিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ফলে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয় রোগীদের।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে একটি ক্যাথল্যাব বন্ধ। এটি মেরামত করতে ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে ৬০ শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ জন চিকিৎসা সেবা নেন। এরমধ্যে অর্ধেক রোগীর হার্টে রিং পরানো (স্টেন্টিং) পেসমেকার স্থাপন, এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি করানো হয়। বর্তমানে চালু থাকা একটি ক্যাথল্যাব দিয়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জন রোগীকে ব্লক শনাক্তকরণ এনজিওগ্রাম ও পেসমেকার স্থাপনের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া রিং পরানো (স্টেন্টিং) হয় ৩-৫ জন। এজন্য কোন কোন রোগীকে দুই থেকে তিন সপ্তাহও অপেক্ষা করতে হয়। সিরিয়াল না পাওয়ায় দ্রুত সেবার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে দিকে ছুটতে হচ্ছে অনেক রোগীদের।
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান বলেন, "হাসপাতালের এসব যন্ত্র বিকল থাকায় গরীর রোগীরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ তাদের সামর্থ্য নেই বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার।"
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, "হাসপাতাল চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের বেশিরভাগ গরীব ও নিম্নবিত্ত। তারা অনেক ব্যয় বহন করতে পারেন না। এমআরআই, ক্যাথল্যাব, ব্র্যাকিথেরাপি, ম্যামোগ্রাফি যন্ত্র মেরামত করতে সংশ্লিষ্টদের বারবার চিঠি দিচ্ছি। মেরামতের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয় আমাদের।"
এসব সমস্যার দ্রুত সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।