বাড়তি উৎপাদন সত্ত্বেও কেন বাড়ছে আলুর দাম?
সরকারি দুই সংস্থার মতে, চলতি বছরে দেশে এক কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদিত হয়েছে, যা দেশের বার্ষিক চাহিদার তুলনায় বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত এক মাস ধরে দেশে আলুর দাম বেড়েই চলেছে।
এদিকে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, চলতি বছরে আলু উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে দুই সরকারি সংস্থা যে তথ্য দিয়েছে, তারমধ্যে গরমিল রয়েছে; হিসাবে যা দেখানো হচ্ছে উৎপাদন হয়েছে তারচেয়ে কম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে এ বছর আলুর উৎপাদন ১.১২ কোটি মেট্রিক টন এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে এই উৎপাদন ১.০৪ কোটি মেট্রিন টন।
তবে গতকাল (১০ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন দাবি করে, এ বছর মাত্র ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন এবং কিছু হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ী কম উৎপাদনের সুযোগ নিয়ে আলুর বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে।
সপ্তাহখানেক ধরে আলুর বাজারে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। ঢাকার বিভিন্ন বাজারে প্রতিকেজি আলু ৫০-৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একমাস আগেও এই আলু বিক্রি হয়েছে ৩৬-৪০ টাকায়।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত বছর একই সময়ে প্রতি কেজি আলুর সর্বোচ্চ দাম ছিল মানভেদে ২৫-৩০ টাকা।
অথচ গত জুলাই মাসে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এক প্রতিবেদনে কৃষি মন্ত্রণালয়কে জানায়, খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি আলুর দাম ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়।
রোববারের সংবাদ সম্মেলনে মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, "কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে এ বছর ১.১২ কোটি টন আলু উৎপাদন হয়েছে, যেখানে চাহিদা ৯০ লাখ টন। তাহলে ২২ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অথচ কোল্ড স্টোরেজগুলোতে এ বছর ২০ শতাংশ সংরক্ষণ জায়গা ফাঁকা রয়েছে।"
"আলু বেশি উৎপাদন হলে হিমাগার ফাঁকা কেন? আমাদের তথ্যমতে, এ বছর ৮৫ লাখ টনের বেশি আলু উৎপাদন হয়নি," বলেন তিনি।
অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বিগত কয়েক বছরে কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীরা সঠিক মূল্য না পাওয়ার কারণে লোকসান করেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গম, ভোজ্য তেল, ভুট্টার দাম বেড়ে যাওয়ায় সরিষা, গম ও ভুট্টার আবাদ বাড়িয়েছেন কৃষকেরা। এ কারণে কম জমিতে আলুর চাষ হয়েছে এবং উৎপাদনও কম হয়েছে।
২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে কোল্ড স্টোরেজে ১.০৭ লাখ মেট্রিক টন কমে আলু সংরক্ষিত হয়েছে ২৪.৯২ লাখ টন। আবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার কোল্ড স্টোরেজে ২.১৬ লাখ টন কম আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, মার্চে আলু পুরোপুরি শেষ হয় এবং কৃষকের কাছে যে আলু থাকে, তা দিয়ে জুন মাস পর্যন্ত দেশের চাহিদা পূরণ করা হয়। এরপর থেকে কোল্ড স্টোরেজের আলু বাজারে আসতে থাকে। কিন্তু এ বছর উৎপাদন কম হওয়ার কারণে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই আলু খালাস শুরু করেছে কোল্ড স্টোরেজ। এ কারণে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আলু সংরক্ষণের পরিমাণ অন্যান্য বছরের তুলনায় কম।
মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, "এ বছর আলুর উৎপাদন খরচ ১২-১৩ টাকা এবং হিমাগার ভাড়া ৫-৬ টাকা। হিমাগার গেটে প্রকারভেদে প্রতিকেজি আলুর মূল্য দাঁড়ায় ১৮-২০ টাকা। অথচ মে মাসের শেষে হিমাগার শেডে প্রতি কেজি আলুর মূল্য ছিল ২৬-২৭ টাকা, যা বাড়তে বাড়তে এখন ৩৪-৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।"
তিনি বলেন, আলু সংরক্ষণকারীরা মনে করছে আলুর মজুদ কম। সেজন্য তারা দাম বাড়াচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এছাড়া, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যদি টিসিবির মাধ্যমে নূনতম ১০ লাখ মেট্রিক টন আলু বাজারমূল্যে ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন হিমাগারে সংরক্ষণ করে রাখে, তাহলে বাজারে এই ধরনের অস্থিরতা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি যে বছর আলু বেশি উৎপাদিত হবে সে বছর ত্রাণ, কাবিখা, ওএমএসসহ সরকারি বিভিন্ন রেশন কাজের মাধ্যমে আলু বিতরণ করলে দাম স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
তবে যে পরিমাণ আলু এখনো আছে, তা দিয়ে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সংকট হবে না এবং ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই নতুন আলু বাজারে আসতে শুরু করবে।
অ্যাসোসিয়েশন বলছে, হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর মধ্যে ৪০ শতাংশ বীজ আলু, ৫৫ শতাংশ খাবার আলু এবং ৪ শতাংশ শিল্পে ব্যবহৃত আলু থাকে। এই ৫৫ শতাংশ খাবার আলু সংরক্ষণ করে আলু ব্যবসায়ী ও কৃষক, যেখানে হিমাগার মালিকদের খাবার আলুর পরিমাণ ১ শতাংশের বেশি নয়।