ঋণে জর্জরিত কৃষি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা আগের মতো ব্যবসা করতে চান
পুড়ে যাওয়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের উত্তর দিকে 'সিয়াম সুজ' নামে একটি জুতার দোকান ছিল আহসান উল্লাহর। আগুনে পুড়ে গেছে প্রায় ১০ লাখ টাকার মালামাল। এ দোকানের উপার্জনেই আহসান উল্লাহর সংসারের চাকা ঘুরতো। স্ত্রী গত এক বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছে অসুস্থ হয়ে। তার চিকিৎসার খরচ, তিন ছেলের পড়াশোনার খরচ সহ তাকে সংসার চালাতে হিমশিমই খেতে হতো ছোট এ দোকানটির মাধ্যমে।
আহসান উল্লাহ শনিবার দোকানটি লোকজন নিয়ে পরিষ্কার করছিলেন। পুড়ে যাওয়া পণ্যগুলোর কয়লা বের করে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। অনেকক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন দোকানের সামনে। তার একটিই চিন্তা কিভাবে পরিবারের খরচ চলবে? কিভাবে পরিশোধ করবেন ঋণের টাকা?
আহসান উল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দোকানের জন্য বিভিন্ন সমিতি এবং আত্মীয়-স্বজনের থেকে প্রায় ৬ লাখ টাকা ঋণে আছি। এছাড়া জুতার কারখানাতেও বাকি আছে অনেক টাকা। দোকানে বিক্রি হলে বাজার হতো। টানাটানিতে সংসার চলতো।"
"আমরা চাই দ্রুত আমাদের মার্কেটটি আগের মতো করে দেওয়া হোক সিটি কর্পোরেশন থেকে। যদি সব করে দিতে নাও পারে, তবে অন্তত টিনশেড করে দিক, বাকি কাজ আমরা করে ব্যবসা শুরু করবো। আমরা বহুতল ভবন চাই না," বলছিলেন আহসান উল্লাহ।
আহসান উল্লাহর মতো মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের প্রায় ৪০টি জুতার দোকান পুড়েছে। বৃহস্পতিবার ভোরের আগুনে এ মার্কেটে পুড়ে যাওয়া ৪ শতাধিক দোকানের ব্যবসায়ীদের দাবি, দ্রুত যেন তাদের ব্যবসা পরিচালনা করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সাথে ব্যবসা পুনরায় শুরু করার জন্য সরকার থেকে প্রণোদনা ও ঋণ চায় ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "আমরা চাই দ্রুত ব্যবসায়ীদের দোকান বসানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ব্যবসার মাধ্যমেই তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা দেখলাম বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য টাকা সংগ্রহ করছে কিন্তু যে টাকা সংগ্রহ হয়েছে তা ভাগ করে দিলে ১০ হাজার টাকাও পাবে না একজন ব্যবসায়ী। এসব সাহায্যের নাম করে যেন কৃষি মার্কেটে কালক্ষেপণ করা না হয়। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ওখানে টিনশেডের ভালো মানের মার্কেট তৈরী করা যায়।"
'ইমন সুজ' এর ব্যবসায়ী নুরুল হক এ মার্কেটে প্রায় ১৫ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, "আমরা বঙ্গবাজারের মতো বসতে চাই না। আমাদের এখানে তাহলে লোক আসবে না। আমাদের খুচরা মার্কেটে ক্রেতারা এসে একটি পরিবেশ না পেলে বিক্রি হবে না। এছাড়া আমাদের পণ্য প্রদর্শনেরও সুযোগ থাকতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের মার্কেট যদি পুনঃনির্মাণ করতে নাও পারে অন্তত টিনের ছাউনি দিয়ে দিক, আমরা দেয়াল নিজেরা করে নিবো। আমরা দোকান দিয়ে না বসতে পারলে সংসার চলবে না। অন্তত ৬ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে আমার।"
আবেদ ওয়াচের মো. আবেদের বিভিন্ন এনজিও ও সমিতি থেকে ঋণ নেওয়া আছে ১০ লাখ টাকার মতো। প্রতি সপ্তাহেই তার ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়। তিনি চান সরকার থেকে যেন কিছু প্রণোদনা দিয়ে ব্যবসা শুরু করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
এ দোকানের ম্যানেজার জয় চন্দ্র দাস বলেন, "আমি নিজে চলি এই দোকানের উপর। পোড়ার দিন বেতন নেওয়ার কথা। এই টাকা নিয়েই রুমের ভাড়া, খাবার টাকা দেওয়ার কথা। সবই শেষ, এখন মালিকের কাছে টাকা চাইবো কেমন করে? দোকান চালু হলে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে ক্ষতি পুষিয়ে উঠা যাবে।"
'রাসেল-ইমরান হার্ডওয়্যার' দোকানে প্লাস্টিক ও অন্যান্য মালামাল পুড়ে কয়লা হয়ে যায় আর শনিবার সেগুলো লোকজন নিয়ে পরিষ্কার করছিলেন দোকানের মালিক মো. আল আমিন।
আল আমিন টিবিএসকে বলেন, "আমাদের তিন দোকানে ৭ জন স্টাফ ছিল। আমি একটি দোকানের দায়িত্বে ছিলাম। তিন দোকানের ও স্টোরের প্রায় ৮০ লাখ টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। দুই দোকানে দুই লাখ টাকার মতো ক্যাশ। কিছুই বের করতে পারিনি।"
তিনি আরও বলেন, "সিটি কর্পোরেশন যদি আমাদের দোকান না করে দেয়, তাহলে বলুক আমরা করে নিবো। আমরা আমাদের ব্যবসা শুরু করতে চাই।"
মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের কারণ এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে কাজ করছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি। ঢাকা উত্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ শরীফ উদ্দীনকে আহবায়ক ও সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা মোঃ মুজাহিদ আল সাফিদকে সদস্য-সচিব করে বৃহস্পতিবার এ তদন্ত কমিটি করা হয়। ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।