আমদানি শুল্ক কমালেও চিনির দাম বাড়ছেই
নির্বাচনের আগে চিনির বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমদানি শুল্ক রেকর্ড পরিমাণে প্রত্যাহার করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তারপরও পাইকারি ও খুচরা বাজারে চিনির দাম ঊর্ধ্বমুখী।
গত ১ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, অপরিশোধিত চিনি আমদানির ক্ষেত্রে বর্তমানে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক দিতে হবে দেড় হাজার টাকা। আর পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক দিতে হবে তিন হাজার টাকা।
আগে অপরিশোধিত চিনি আমদানির ক্ষেত্রে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক দিতে হতো তিন হাজার টাকা। আর পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক ছিল ছয় হাজার টাকা। অর্থাৎ, উভয় ধরনের চিনির আমদানি শুল্ক কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে।
শুল্ক কমানোর পর আমদানি পর্যায়ে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনির সামগ্রিক আমদানি ব্যয় কমেছে। এতে পাইকারি ও খুচরা বাজারে চিনির দাম কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু গত ১৫ দিনে পণ্যটির দাম না কমে উল্টো বেড়ে গেছে।
পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গত দুই সপ্তাহে চিনির দাম প্রতি মণে বেড়েছে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, মঙ্গলবার প্রতি মণ চিনি (৩৭ দশমিক ৩২ কিলোগ্রাম) ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা।
পাইকারি বাজারে চিনির দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। দুই সপ্তাহে খোলা চিনির দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকায়। যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১৩৫ টাকা।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, সরকার শুল্ককর কমালেও মিলাররা চাহিদামাফিক সরবরাহ না দেওয়ায় বাজারে চিনির দাম কমছে না। মিলার ও ডিও বিক্রেতারা কারসাজির মাধ্যমে চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন।
খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, 'বাজারে চিনির বিক্রি কম। তারপরেও দাম বাড়ছে। কারণ মিলার ও প্রথম হাতবদলকারী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে চিনির বাজার বন্দি। খাতুনগঞ্জের যারা ডিও বিক্রি করেন তাদের সঙ্গে মিলারদের যোগসাজশ রয়েছে।'
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, 'সরকার শুল্ক কমালেও এর প্রভাব পাইকারি বাজারে পড়েনি। উল্টো দুই সপ্তাহ ধরে চিনির দাম বেড়েছে। তবে বিক্রি কম।'
তিনি বলেন, 'মিলারদের ১০ শতাংশ শুল্ক কমানোর দাবি ছিল। কিন্তু সরকার এক দশমিক পাঁচ শতাংশ কমিয়েছে। মূলত শুল্ক কমালেও মিলাররা চিনি সরবরাহ দিচ্ছেন না। সরবরাহ না দিলে বাজারে দাম কমার তো কোনো সম্ভাবনা নেই। এতে সরকার শুল্ক কমালেও গ্রাহক পর্যায়ে এর সুফল মিলছে না।'
এদিকে ডিও ক্রেতারা অভিযোগ করে বলছেন, খাতুনগঞ্জে চিনির বাজার নানা সিন্ডিকেটের কাছে বন্দি। এস আলমের চিনি কিনলেও তাদের নির্ধারিত ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে চিনি পরিবহন ও সরবরাহ নিতে হয়। নির্ধারিত ওই ট্রান্সপোর্টের লোকদের খুশি রাখা না গেলে আগে কিনেও এস আলম ফ্যাক্টরি থেকে চিনি সরবরাহ পাওয়া যায় না।
এদিকে পাইকারি বাজারের মতো খুচরা পর্যায়েও চিনির দাম নিয়ন্ত্রণহীন। চট্টগ্রাম নগরীর জামাল খান এলাকার মুদি দোকানি আবসার উদ্দিন বলেন, 'আমরা মঙ্গলবার ১৩৫ টাকা কেজিতে চিনি কিনে এনেছি। এখানে খুচরা ভোক্তাদের কাছে ১৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। সরকার শুল্ক কমানোর কথা বলেছেন, কিন্তু বাজারে উল্টো দাম বেড়েছে।'
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম চিনি প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, 'চিনিতে শুল্ক প্রত্যাহারের প্রভাব বাজারে পড়তে আরও সময় লাগবে। কারণ ইতোমধ্যে যেসব চিনি আমদানি করা হয়েছে এবং খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে সেগুলো আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের সুবিধা পায়নি।'
তিনি বলেন, 'নির্বাচনকে ঘিরে চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরও এক মাস আগে এই সিদ্ধান্ত নিলে নির্বাচনের আগেই সুফল পাওয়া যেত।'
বাজারে চিনি সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক উল্লেখ করে বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, 'কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই।'
জানা যায়, দেশে বছরে কমবেশি ১৮ থেকে ২০ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে আসে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টনের মতো। গত বছর থেকে তা ২৫ হাজার টনে ঠেকেছে। অবশিষ্ট চিনি আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়।
দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর আমদানি করতে হয় প্রায় ৯৬ শতাংশের বেশি চিনি। ব্যক্তিখাতের পাঁচ শিল্পগ্রুপ সিটি, মেঘনা, এস আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু সুগার মিল অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। পরে নিজেদের মিলে পরিশোধন করে বাজারজাত করে।
সিটি ও মেঘনা গ্রুপ জায়ান্ট আমদানিকারক। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রামের আলোচিত শিল্পগ্রুপ এস আলম।