এখনো শীতের দেখা নেই, ১-২টি শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে ডিসেম্বরের শেষে
এ বছর দেশে কিছুটা দেরিতে শীত পড়বে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রোববার (৩ ডিসেম্বর) প্রকাশিত পূর্বাভাসে জানানো হয়, এ মাসের শেষদিকে দেশের কোথাও কোথাও ২-১টি মৃদু বা মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
এ বছর স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টিপাত কম হয়েছে, কাজেই 'ঊন বর্ষায় দুনো শীত' অর্থাৎ যে বছর বৃষ্টি কম হবে সে বছর শীত বেশি পড়বে- প্রবাদমতে এবার বেশ শীত পড়ার কথা। কিন্তু এই ডিসেম্বর মাসেও এখন পর্যন্ত ঢাকা শহরে শীত অনুভূত হচ্ছে না বললেই চলে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে উঠে এসেছে, শীত এবারে কিছুটা দেরিতে আসবে এবং শীতের প্রভাব থাকবে অন্যান্য বছরের তুলনায় খানিকটা কম।
পৌষ মাস শুরু হতে আর মাত্র দিন দশেক বাকি। ইংরেজি মাস হিসেব করলে ডিসেম্বরে আগে পুরোপুরি শীতের আবহ থাকতো। কিন্তু ঢাকায় এখনও রাতের বেলায় সিলিং ফ্যানের ব্যবহার বন্ধ হয়নি, মানুষের গায়ে শীতের পোশাকও ওঠেনি।
এ অবস্থা শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলেও শীতের তীব্রতা অনুভুত হচ্ছে না এখন পর্যন্ত।
অথচ নভেম্বর বা অগ্রহায়ণের শুরু থেকেই শীতের আগমনী বার্তা শুরু হয়। এবং বিগত বছরগুলোতে এ সময়ে ভালোভাবেই শীত পড়েছে।
সাম্প্রতিক আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ মাসে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অপেক্ষা কিছুটা বেশি থাকতে পারে। তবে মাসের শেষভাগে দেশের কোথাও কোথাও ১-২টি মৃদু বা মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
অর্থাৎ, তীব্র শীতের অনুভূতি পেতে হলে ডিসেম্বরের শেষভাগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
গতকাল (৪ ডিসেম্বর) দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখা গেছে, সারাদেশের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৩০.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন গড় তামপাত্রা ২০.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকতে পারে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তৈরি হওয়া নিম্নচাপে আকাশ সারাদিনই মেঘলা ছিল।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ডিসেম্বর মাসে গত ৩০ বছরের রাতের গড় তাপমাত্রা ১৪.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ১০-১৫% কম বা বেশি হওয়াকে স্বাভাবিক ধরা হয়। কিন্তু এই পরিবর্তন যখন ২০-৩০% কম-বেশি হবে তখন তাকে স্বাভাবিক থেকে কিছুটা বেশি বলা হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরও শীতের স্বাভাবিক তাপমাত্রাটা একটু বেশিই থাকবে বলে প্রক্ষেপণ করছে।
শীতের প্রভাব কেন কম?
আবহাওয়াবিদরা জানান, মূলত এল-নিনোর প্রভাবেই এবার শীতের প্রভাব কম থাকার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে।
এল নিনোর প্রভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত বায়ুর গতিবেগ কম থাকে। সাগরপৃষ্ঠে বাষ্পায়নের হার কমে যায়, যে কারণে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে। জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে গেলে তা তাপমাত্রা কমাতে কম প্রভাব রাখে। এটা বৃষ্টিপাত কমানোর ক্ষেত্রেও ভুমিকা রাখে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ডা. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক টিবিএসকে বলেন, "এল নিনোর প্রভাবের কারণেই এবারে বলা হচ্ছে শীতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি থাকতে পারে। তবে এ মাসের শেষেই একটি বা দুটি মৃদু বা মাঝারি শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে।"
শীতের সময়কাল সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসেব করা হলেও এই সময়কালটা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, উঞ্চতা বৃদ্ধিসহ নানা কারণেই এই সময়কালটার প্যাটার্ন একটু একটু পাল্টে যাচ্ছে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ২৪ ডিগ্রী সেলসিয়ায় তাপমাত্রাকে সর্বোচ্চ স্বস্তিদায়ক তাপমাত্রা হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিবেচনা করা হয়। এটা ধীরে ধীরে কমে ২০-১৮ ডিগ্রীর নিচে নামতে থাকলে শীতের অনুভূতি হতে থাকে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের নভেম্বর মাসের তাপমাত্রার তথ্য বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গত ১ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রী এবং ২৭ নভেম্বর তেঁতুলিয়ায় ১৩.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
এই মাসে দেশের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিক অপেক্ষা যথাক্রমে ১.২ ডিগ্রী বেশি এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস কম ছিল। সারাদেশের গড় তাপমাত্রা ছিল ১.১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি।
অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছর স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ছিল কম। এতেও ছিল এল নিনোর প্রভাব। জুন-জুলাই মাসে রেকর্ড পরিমাণে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি বেশি হলেও তা ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় খানিকটা কম।
আবহাওয়াবিদরা জানান, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় উষ্ণতা বেড়ে এল নিনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যে কারণে এ বছর বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ উঞ্চতার রেকর্ড হয়েছে।
বিলম্বিত শীতে প্রভাব পড়তে পারে কৃষিতে
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল হাকিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গম উৎপাদনের জন্য ১৮-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সবচেয়ে উপযোগী। গমের জন্য দিনে পর্যাপ্ত আলো এবং রাতে প্রচণ্ড শীত দরকার। কিন্তু এবারের আবহাওয়ার যে চিত্র এবং শীত কম হওয়ার যে পূর্বাভাস করা হচ্ছে তা-তে গমের ভালো ফলন পাওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, 'গমের ফলনের দুটো ধাপ রয়েছে। একটি গাছের বৃদ্ধি পর্যায়, অন্যটি ফল। গাছের বৃদ্ধির সময়ে তাপমাত্রা কমবেশি হলে সমস্যা নেই, কিন্তু ফলন পর্যায়ে তাপমাত্রা বেশি থাকলে ফলন কমে যাবে।'
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর সরেজমিন গবেষণা বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাজহারুল আনোয়ার টিবিএসকে বলেন, 'শীতে আমাদের আলু, নানা ধরনের সবজি, সরিষাসহ বিভিন্ন ফসল হয়ে থাকে। এ ফসলগুলোর জন্য পর্যাপ্ত শীত দরকার। শীত বেশি হলে ফসলের উৎপাদন বাড়ে, কম হলে উৎপাদনে প্রভাব পড়ে।'
তিনি বলেন, 'আমরা এ পরিবর্তিত আবহাওয়ার উপযোগী ভ্যারাইটি ডেভেলপ করার মাধ্যমে ফলন ধরে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।'