বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর: মিঠা পানির সরবরাহ নিশ্চিতে লবণাক্ততা দূরীকরণ প্রকল্প নিচ্ছে বেজা
দেশের সবচেয়ে বড় ও পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর বাস্তবায়নে মিঠা পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে ডিস্যালাইনেশনের (পানির লবণাক্ততা দূরীকরণ) কথা ভাবছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামা ও দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ফেনী নদী ও সাগরের পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং হালদা নদী থেকে পানি সংগ্রহের প্রকল্প বাতিল হওয়ায় মিঠা পানির সরবরাহ নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। এ সংকট মোকাবিলায় সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা দূরীকরণের মাধ্যমে সমাধান খুঁজছে বেজা।
বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ডিস্যালানাইনেশন প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য পরামর্শক নিয়োগ ও সমীক্ষা প্রতিবেদন পেতে সবমিলিয়ে দেড় বছরের মতো সময় লাগবে। সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে প্রকল্প নেওয়া হবে।"
প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৩০ মিলিয়ন লিটার (এমএলডি) সক্ষম পানি শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সংস্থাটি। চট্টগ্রামের মিরসরাই অংশে বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেল থেকে পানি সংগ্রহ করা হবে। এ লক্ষ্যে 'ফিজিবিলিটি ফর এস্টাব্লিশিং ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট অ্যাট বিএসএমএসএন' শীর্ষক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে বেজা। পরামর্শক নিয়োগে গত ১৪ নভেম্বর দরপত্রও আহ্বান করেছে সংস্থাটি।
লবাণক্তা দূরীকরণ সমীক্ষার দরপত্রে মূলত তিনটি বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তা হলো— শিল্পনগরের বর্তমান পানি সরবরাহ ব্যবস্থার চিত্র ও লবণাক্ততা দূরীকরণ প্ল্যান্টের প্রয়োজনীয়তা এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা।
চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় ৩০,০০০ একর জমিতে নিয়ে এই শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে এখানে ৮টি শিল্প ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। ২১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন আছে। আগামী ৪ মাসের মধ্যে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরুর লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
সমীক্ষায় দৈনিক ৩০ মিলিয়ন লিটার সক্ষম (সমীক্ষায় চূড়ান্ত হবে সক্ষমতা) লবণাক্ততা দূরীকরণ প্ল্যান্ট (ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট) বাস্তবায়নের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলের উপযুক্ত রূপরেখা প্রদান করা হবে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক, আয়-ব্যয় অনুপাত, সেবা গ্রহণকারীদের ব্যয়সহ বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরা। এছাড়াও, পিপিপি মডেলের প্রকল্পটিতে বেসরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সুযোগ, ঝুঁকিসহ সবকিছু নির্ণয় করা হবে সমীক্ষার মাধ্যমে।
পানির সংকট বড় বিনিয়োগকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে—এর নিকট উদাহরণ হলো দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পাঞ্চল বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর।
এর আগে, পানির সংস্থানে ৫০টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ফেনী-মুহুরি-সিলোনিয়া নদী (মুহুরী রিজার্ভার) থেকে ৫০ এমএলডি পানি সক্ষম শোধনাগার এবং চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনা থেকে রেলট্র্যাকে ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসিয়ে ৫০০ এমএলডি পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এরমধ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধানে চাঁদপুরের প্রকল্পটি ভবিষ্যৎ স্থায়িত্ব ও পানির সাম্ভাব্য বর্ধিত মূল্যের কারণে পিছু হটতে চাইছে বেজা। তবে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ মনে করছে, সরকারের নির্দেশনায় প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা। ব্যয়বহুল ডিস্যালাইনেশন প্রকল্পের সমাধান টানা সম্ভব নয়।
বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, পুরো শিল্পাঞ্চলে ২০২৫ সালে দৈনিক অপরিশোধিত পানির চাহিদা দাঁড়াবে ৩৬৪ মিলিয়ন লিটার (এমএলডি); ২০৩০ সালে ৫১৬ এমএলডি, ২০৩৫ সালে ৭৩০ এমএলডি ও ২০৪০ সালে ১,০৩৩ এমএলডি হবে।
এ চাহিদা পূরণ করতে ফেনী-মুহুরি-সিলোনিয়া নদী (মুহুরী রিজার্ভার) থেকে ১০০ এমএলডি, ছোট ফেনী নদী থেকে ৪০ এমএলডি, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং থেকে ১৭৯ এমএলডি, ফেনী ওসমানপুর পানি শোধনাগার থেকে ১০৫ এমএলডি, মোহরা পানি শোধনাগার ফেজ-০২ (হালদা নদী) থেকে ৯০ এমএলডি ও সমুদ্রের পানি পরিশোধন (ডি-স্যালাইনেশন) থেকে ২০০ এমএলডি; মোট ৯১৯ এমএলডি পানি সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছিল বেজা।
কিন্তু পরিবেশবাদীদের বিরোধীতার মুখে হালদা নদী থেকে পানি সংগ্রহের বিষয়টি বাতিল করতে হয়। অথচ শিল্পাঞ্চলে পানির সংস্থানের সবচেয়ে নিকটবর্তী বড় উৎস ছিল এটি। বর্তমানে পানির চাহিদা পূরণে ৫০টি গভীর নলকূপই বেজার একমাত্র ভরসা।
অন্যদিকে, ফেনী নদীর পানির লবণাক্ততা বেড়ে যায় শুষ্ক মৌসুমে। আর মিসরাইয়ের ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা, আর্সেনিক ও জীবাণু উপস্থিতি রয়েছে।
গুনতে হবে পানির বর্ধিত মূল্য
বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ শিল্পাঞ্চল, ইপিজেডসহ শিল্প কারখানাগুলোকে প্রতি এক হাজার লিটার পানির জন্য ৩৭-৪০ টাকা ব্যয় করতে হয়। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের কারখানাগুলোকে বর্ধিত ব্যয় গুনতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ এ অঞ্চলের পানির সংস্থান হচ্ছে ব্যয়বহুল প্রকল্পের মাধ্যমে। পানি সংকটের কারণে বিনিয়োগ ফিরে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল (ইপিজেড) বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের মিরসরাই অংশে হচ্ছে। ১১৩৮.৫৫ একর জমিতে ৫৩৯টি প্লট করা হয়েছে। বন্দরকেন্দ্রিক সুবিধার কারণে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা ইপিজেড পর্যন্ত প্লট খালি নেই। কিন্তু পানির সংকটের কারণে মিরসরাইয়ের ইপিজেডে অনেক প্রতিষ্ঠান মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এরমধ্যে চলতি বছর বড় আকারের বিনিয়োগ নিয়ে আসা টেক্সটাইল খাতের দুটি প্রতিষ্ঠান ফিরে গেছে।
বর্তমানে মাত্র ২৫ শতাংশ প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অধিক পানির প্রয়োজন এমন– ইন্ডাস্ট্রিকে নিরুৎসাহিত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বেপজার এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, পানির সরবরাহ নিশ্চিত হলেও দূরবর্তী মেঘনা নদী থেকে পানি এনে এখানে সরবরাহ করলে অন্যান্য ইপিজেড থেকে পানির খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও একই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। কারণ বিদেশি প্রতিষ্ঠান পিপিপি মডেলে অর্থায়ন করবে পানি বিক্রি করতে।
প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক আরও বলেন, "বিদেশি বিনিয়োগ আসছে ইউটিলিটি সুবিধা এবং সস্তা শ্রমের কারণে। পানি যদি ব্যয়বহুল হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তারা লাভ-লোকসান হিসাব করেই বিনিয়োগ করবে। আমরা বলে আসছি, পানিসহ অন্যান্য ইউটিলিটি সাশ্রয়ী মূল্যে দিতে হবে।"
তিনি বলেন, "পানির দাম সাশ্রয়ী করতে আমরা বিভিন্ন উৎস থেকে পানি সংগ্রহের চিন্তা করছি। ডি-স্যালাইনেশনের ক্ষেত্রে বেশি পানি পরিশোধন করলে খরচ কমে আসবে বলে জানি। বাকিটা সমীক্ষার পর বলা যাবে।"
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "চট্টগ্রাম শহরে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য প্রতি এক হাজার লিটার পানি ৩৭ টাকায় দেওয়া হয়। এখানে ঋণ, ঋণের সুদ, সংস্কারের ব্যয় ধরা হয় না। সরকার ভর্তুকি দেয়। সবকিছু হিসেব করলে ব্যয় অনেক বেশি হবে।"
"চাঁদপুর থেকে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পানি সরবরাহ করা হবে পিপিপি মডেলে। এখানে সরকার ভর্তুকি দেবে না। ব্যয় অনুসারেই পানির মূল্য নির্ধারণ হবে। ভারতের শিল্পখাতে পানি বিক্রি হয় ১৫০-২০০ টাকায়। সারাবিশ্বে প্রচলন আছে— শিল্প কারখানার পানিতে সরকার ভর্তুকি দেয় না," যোগ করন তিনি।