প্রতিরোধী জাত না থাকায় ব্লাস্ট রোগে কমছে ধানের উৎপাদন
বাংলাদেশের প্রধান দুই খাদ্যশস্যের একটি ধান। উৎপাদন পর্যায়ে এ শস্যের প্রধান শত্রু ব্লাস্ট রোগ। কিন্তু ধানের ক্ষেত্রে এখনও ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী কোনো জাত উদ্ভাবন হয়নি। এর ফলে প্রতি বছর যে পরিমাণ ধানের উৎপাদন হচ্ছে, তার ১ শতাংশের মতো ফলন ব্লাস্ট রোগে নষ্ট হচ্ছে বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর তথ্যে। প্রতি বছর প্রায় চার কোটি টন চাল উৎপাদন হয় সারা দেশে।
ব্রি এখন ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী ধানের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে। গবেষকরা বলছেন, চলমান বোরো মৌসুমে কৃষকদের মাঠে নতুন জাতটির পরীক্ষামূলক চাষ হচ্ছে।
পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল পেলে জাতটি অবমুক্ত করার জন্য জাতীয় বীজ বোর্ডের চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে বলে জানান তারা।
গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের দুটি প্রধান খাদ্যশস্য ধান ও গমের প্রধান এবং সাধারণ শত্রু হচ্ছে ব্লাস্ট রোগ। তবে রোগ প্রতিরোধী ও সহনশীল জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে গমে এই রোগের প্রভাব অনেকটাই ঠেকানো গেছে।
তারা বলছেন, ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত রোগ এবং অনুকূল আবহাওয়ায় চারা থেকে পাকা ধানে পর্যন্ত এ রোগ দেখা দিতে পারে। এ রোগ ধানের পাতা, গিঁট এবং নেক বা শীষসহ গাছে অন্যান্য অংশে আক্রমণ করে থাকে।
ব্রির তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে ব্লাস্ট রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে, যা ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এরপর থেকে ব্যপক আকারে দেখা না দিলেও প্রতি বছরই এই রোগে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, একটু একটু করে প্রভাব বাড়ছে।
গবেষকরা বলছেন, রোগটি আমন মৌসুমে—যে মৌসুমে দেড় কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়—নভেম্বরের দিকে মূলত সুগন্ধি চালের ধানে আক্রমণ করে।
এছাড়া দেশের চাল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মৌসুম বোরোতে এই রোগটি পাওয়া যায় উচ্চ ফলনশীল (উফশী) এবং চিকন চালের জাতগুলোতে বেশি আক্রমণ করে। এর পাশাপাশি আগাম জাতের এবং সুগন্ধি জাতের ধানেও পাওয়া যায়।
বর্তমানে ব্রি ধান-২৮, ২৯, ৫০, ৬৩, ৮১, ৮৪ ৮৮-সহ বিভিন্ন জাতেই এর আক্রমণ উল্লেখযোগ্য।
ব্রির তথ্যমতে, কুমিল্লা, গাজীপুর ও রংপুর অঞ্চলে এই রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। যে বছর মার্চে বৃষ্টি হয়, সে বছর এর প্রকোপ বেশি থাকে বলে জানান গবেষকরা, যা আগাম জাতগুলোতে বেশি ক্ষতি করে।
গবেষকরা বলছেন, এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। উফশী জাতের মাধ্যমেই দেশের চালের উৎপাদন একটা স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছেছে।
ব্রির প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আশিক ইকবাল খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ধানের ব্লাস্ট রোগ বিভিন্ন ধাপে ওষুধ দিয়ে প্রতিরোধ করা যায়, যেখানে নির্দিষ্ট মাত্রার সঠিক ওষুধটা ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো সমাধান হলো এই রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন।'
তিনি জানান, 'এমন একটি রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনের একেবারে শেষ ধাপের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছি আমরা।'
এই রোগের প্রভাব বৃদ্ধির প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন বলে জানান আশিক ইকবাল খান। 'বোরো মৌসুমে সাধারণত আগাম বৃষ্টি হলে (মার্চে) এই রোগের প্রভাব বাড়ে।'
এই গবেষক জানান, জাতীয়ভাবে এই রোগের প্রভাব হয়তো সেভাবে টের পাওয়া যায় না, কারণ প্রতি বছর ১ শতাংশেরও কম ধানের উৎপাদন কম হয়। কিন্তু যে জমিতে ব্লাস্ট আক্রমণ করে, সেখানে এর মাত্রা তীব্র হলে শতভাগ ফসলই নষ্ট করে দেয়। সেই হিসেবে এর তীব্রতা ভয়াবহ।
তাপমাত্রা যদি ২৫-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে এবং বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে ব্লাস্ট রোগ আক্রমণ করে। এই পরিস্থিতিতে কোনো জমিতে বেশি পরিমাণে ইউরিয়া সার ব্যবহারেও এর আক্রমণ লক্ষ করা যায়।
তবে গমের ব্লাস্ট রোগের আক্রমনের জন্য সহনশীল তাপমাত্রা ২০-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর সঙ্গে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকলে এ রোগ আক্রমণ করে। গম উৎপাদনের মৌসুম মূলত শীতকাল।
ব্লাস্ট প্রতিরোধী গম
ধানে ব্লাস্ট রোগের বিস্তার বাড়লেও গম উৎপাদনে এর প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে করছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট।
প্রতিষ্ঠানটির গবেষকরা বলছেন, এটা সম্ভব হয়েছে শুধু ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী গমের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে।
এই জাতগুলো চাষ করলে রোগটি চারার ক্ষতি করতে পারে না, আবার কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতি করলেও সেটা নামমাত্র। দেশে প্রতি বছর ১১-১২ লাখ টন গম উৎপাদন হয়।
ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বারি-৩৩ও বিডাব্লিউএমআরআই-গম-৩। একই সঙ্গে আছে বেশ কিছু এই রোগ সহনশীল জাত। তার মধ্যে রয়েছে বিডাব্লিউএমআরআই-গম-১ ও ৫, বারি গম-৩০ ও ৩২। ২০১৬-১৭ সালে এই রোগে গমের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরই ব্লাস্ট প্রতিরোধী এই জাতগুলো উদ্ভাবিত হয়েছে বলে জানান গবেষকরা।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবু জামান সরকার টিবিএসকে বলেন, 'গমে এখন এই রোগের প্রকোপ এবং প্রভাব কম। এর প্রধান কারণ হলো বেশ কিছু রোগ-প্রতিরোধী ও সহনশীল গমের জাত রয়েছে।'