যে কারণে শিশুর খৎনা পেডিয়াট্রিক সার্জনের কাছে করানো উচিত
মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকার দুটি বেসরকারি হাসপাতালে খৎনা করতে গিয়ে মর্মান্তিকভাবে মারা গেছে দুই শিশু। দুইবারই অভিযোগ উঠেছে, শিশু দুটিকে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ব্যবহৃত জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে পুরোপুরি অজ্ঞান করার কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। দুটি সার্জারির ক্ষেত্রেই সার্জারি করেছেন অ্যাডাল্ট সার্জন ও অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট।
শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, পেডিয়াট্রিক সার্জনের দক্ষ টিমের অধীনে প্রটোকল মেনে খৎনা না করায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে পেডিয়াট্রিক সার্জন ও পেডিয়াট্রিক অ্যানেস্থেশিওলজিস্টের টিম দেখে, ভালো হাসপাতালে শিশুদের খৎনা করার পরামর্শ তাদের।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিওনেটাল অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক সার্জারির অধ্যাপক ড. আব্দুল হানিফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শিশুদের সার্জারির জন্য পেডিয়াট্রিক সার্জন ও পেডিয়াট্রিক অ্যানেস্থেশিওলজিস্টের একটি ভালো টিম, পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও অ্যানেস্থেশিয়ার ইকুইপমেন্ট-সাপোর্টিভ মেডিসিন জরুরি।
রোগীকে প্রস্তুত করা গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে এই সার্জন বলেন, শিশুর অ্যাজমা বা অন্য কোনো অসুখ আছে কি না, তা পরীক্ষা করা জরুরি।
ড. হানিফ বলেন, ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে খৎনা করছে। '৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে আমরা অজ্ঞান করে খৎনা করি; এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা হলেও তা ম্যানেজ করা হয়েছে।
'যেকোনো অপারেশনে অ্যানেস্থেশিয়ার ঝুঁকি আছে, কিন্তু যদি দক্ষ টিম থাকে তাহলে ঝুঁকিটা কমানো যায়। বিশ্বব্যাপী অ্যানেস্থেশিয়ার ঝুঁকির কারণে ১ লাখে ১ জন রোগী মারা যেতে পারে যেকোনো অপারেশনে। আমাদের দেশে এই হার ১০ হাজারে একজন।'
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্জারির সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম টিবিএসকে বলেন, একটি শিশু শারীরবৃত্তীয় ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক থেকে আলাদা।
'সুতরাং, একজন অ্যাডাল্ট সার্জন বা অ্যানেস্থেশিয়া চিকিৎসক খুব ভালো সার্জন বা অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট হলেই তিনি যে বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও ভালো হবেন, তা না-ও হতে পারে। বাচ্চাদের ওষুধের ডোজ আলাদা, সেজন্য পেডিয়াট্রিক অ্যানেস্থেশিয়া চিকিৎসকদের আলাদা দক্ষতা থাকতে হয়,' বলেন তিনি।
গত ৮ জানুয়ারি ঢাকার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফুল অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে খৎনা করার পর পাঁচ বছর বয়সি আয়ান আহমেদ মারা যায়। সাত দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর সে মারা যায়। চিকিৎসায় অবহেলার কারণে তার ছেলের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আয়ানের বাবা।
গত মঙ্গলবার রাতে আহনাফ তাহমিন আয়হাম (১০) নামের আরেক শিশু খৎনা করার সময় জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কারণে মারা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকার মালিবাগে জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে।
চিকিৎসকেরা জানান, যখন স্কুল বন্ধ থাকে, বিশেষ করে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে শিশুদের খৎনা বেশি করা হয়।
স্কুল যখন ছুটি থাকে, তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিনে ১০-২০টি খৎনা করা হয়। এসব রোগী ভর্তি হয় না, অপারেশন করে চলে যায়। একে ডে কেয়ার সার্জারি বলা হয়।
সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ বা যেসব বেসরকারি হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক সার্জারি ডিপার্টমেন্ট আছে, সেসব হাসপাতালে খৎনা বা এ ধরনের সার্জারিতে মৃত্যুর ঘটনা কম ঘটে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
অভিভাবকদের সতর্ক হতে হবে
কয়েকজন চিকিৎসক টিবিএসকে বলেছেন, যেকোনো অপারেশনের আগে ৪ ঘণ্টা খালি পেটে থাকতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই সময়ের মধ্যে বাচ্চাকে কিছু খাওয়ালেও অভিভাবকেরা সেটি চিকিৎসককে জানান না। পরবর্তীতে অনেকসময় এ থেকে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই অভিভাবকদের উচিত চিকিৎসককে সব তথ্য ঠিকমতো দেওয়া।
ড. মাহবুবুল আলম বলেন, খৎনা করতে গিয়ে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলোর খবর পেয়ে অনেকে বলেছেন হাজমের কাছে খৎনা করা ভালো। 'হাজমের কাছে অনেকে যায়, তাদের কিন্তু জটিলতাও হচ্ছে। আমাদের এখানে অনেক গুরুতর রোগী আসে, অনেকে মারাও যায়। এতে প্রান্তিক ও দরিদ্র পরিবারের সন্তান থাকে, তাই তাদের নিয়ে আলোচনা হয় না বলে কেউ জানে না।'
খৎনার জন্য বাচ্চাকে শিশু সার্জন ও শিশু অ্যানেস্থেশিওলজিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত বলে পরামর্শ দেন তিনি। 'বাংলাদেশে এখন পর্যাপ্ত পেডিয়াট্রিক সার্জন ও পেডিয়াট্রিক অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট আছে।'
বিএসএমএমইউ-এর অ্যানেস্থেশিয়া, অ্যানালজেসিয়া ও নিবিড় পরিচর্যা মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ড. দেবব্রত বনিক টিবিএসকে বলেন, শিশুদের যত খৎনা হয়, তার ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, 'বাচ্চারা সাধারণত তাদের সমস্যা বলতে পারে না, কো-অপারেটিভ হয় না; তাই জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়, যাতে সার্জন ভালোভাবে কাজটা করা যায় এবং রোগীও ব্যথা না পায়,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, তবে শিশুদের অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়ার আগে যথাযথভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে রোগীর কোনো রোগ আছে কি না, কোনো ওষুধে অ্যালার্জি আছে কি না।