ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুর কবলে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ, ২৩ নাবিক জিম্মি
২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার কাছে ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছে।
জাহাজটি গত রোববার মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল। সোমবার জলদস্যুদের কবলে পড়ে এটি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার কোনো বাংলাদেশি জাহাজ জলদস্যুদের হামলার শিকার হলো।
জাহাজের মালিকানাধীন কোম্পানি এসআর শিপিং-এর কর্মকর্তারা বলেছেন, ক্রুরা গতকাল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
এসআর শিপিংয়ের সিইও মেহরুল করিম মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বিকেলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জাহাজটি কোম্পানিকে দুপুর দেড়টার দিকে সবাই নিরাপদ আছে জানিয়ে একটি বার্তা পাঠাতে সক্ষম হয়।'
'দুইদিন আগে এমভি আবদুল্লাহর গতিপথ পরিবর্তন করে সোমালিয়ার দিকে ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য করে জলদস্যুরা। তারা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। আমরা আজ দুপুর দেড়টার দিকে জলদস্যুতার বিষয়ে জানতে পারি,' বলেন তিনি।
ক্রুদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করে করিম বলেন, 'সকল ক্রু সুস্থ আছেন এবং আমরা তাদের নিরাপদ উদ্ধারে আন্তরিকভাবে কাজ করছি। পূর্বে একই রকম সংকটের সম্মুখীন হওয়ায় এ পরিস্থিতিকে কার্যকরভাবে সামলানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের।'
তিনি আরও বলেন, জলদস্যুরা কোনো ধরনের মুক্তিপণের ব্যাপারে এখনো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, তারা ইতোমধ্যেই জাহাজ এবং জাহাজে থাকা নাবিকদের উদ্ধারে সহায়তা করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে।
আরও পড়ুন: সশস্ত্র জলদস্যুরা আমাদের সোমালি উপকূলে নিয়ে যাচ্ছে: ছিনতাই হওয়া জাহাজ থেকে জানালেন নাবিক
অধিদপ্তরের প্রধান নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন বলেন, 'আমরা আশা করি আমরা ক্রুদের সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করতে পারব।'
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম বলেন, 'আমরা জাহাজের ক্রুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা থেকে বিরত আছি। আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য জাহাজ এবং এর ক্রু উভয়কে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা।'
'আমরা আশাবাদী যে ক্রু সদস্যরা অক্ষত আছেন। জলদস্যুরা সাধারণত জাহাজের ক্রুদের ক্ষতি করে না; তাদের একমাত্র লক্ষ্য মুক্তিপণ আদায় করা,' তিনি আরও বলেন।
এদিকে আরমান হোসেন বাবু নামক একই কোম্পানির অন্য জাহাজে কর্মরত এক নাবিকের কাছে ভয়েস রেকর্ডিং পাঠিয়েছেন জাহাজটির একজন নাম না জানা ক্রু। সেখানে জলদস্যুর সংখ্যা সাত–আটজন উল্লেখ করে তিনি আশঙ্কা করেছেন, জলদস্যুরা সম্ভবত জাহাজটিকে সোমালি উপকূলে তাদের ঘাঁটিতে নিয়ে যাচ্ছে।
এসআর শিপিংয়ের মালিক কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম টিবিএসকে ভয়েস বার্তার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
ভয়েস রেকর্ডিংয়ে ভুক্তভোগী নাবিককে বলতে শোনা যায়, 'তারা [জলদস্যু] আমাদেরকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমরা সবাই [জাহাজের] ব্রিজে আটক আছি। আমি এখন ওয়াশরুমে এসে আপনাকে ভয়েস [বার্তা] দিচ্ছি [পাঠাচ্ছি]। ওরা সাত–আটজন আছে — পাইরেটস। ওরা হয়তো আমাদেরকে ওদের ওখানে নিয়ে যাবে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ওদের সবার কাছে গান [বন্দুক] আছে।'
আরমানকে পাঠানো আরেকটি রেকর্ডিংয়ে ওই নাবিক আরও বলেন, 'তারা [জলদস্যু] দুই মাস আগে একটি ইরানি ফিশিং বোট আটক করেছিল। সেই নৌকাটি আমাদের জাহাজের সঙ্গে বাঁধা আছে। তারা মূলত সেই নৌকা থেকে আমাদের জাহাজে হামলা করেছিল। এখন ওই ফিশিং বোটটা তারা ছেড়ে দেবে। আমরা তাতে ডিজেল দিয়েছিলাম।
'তারপর আমাদেরকে নিয়ে হয়তো সোমালি উপকূলে ওদের আস্তানায় চলে যাবে। দোয়া করবেন। সবাই জানে হয়তো। অফিসকেও জানানো হয়েছে।'
জাহাজে থাকা ক্রু সদস্যরা হলেন ক্যাপ্টেন রশিদ মোহাম্মদ আবদুর, চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার মো. তারেকুল, ডেক ক্যাডেট হোসেন মোহাম্মদ সাব্বির, চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. আক্কান উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার আহমাদ তানভীর, ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইব্রাহিম উল্লাহ খলিল, মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, মোহাম্মদ আসিফ উর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, মাহামুদ জয়, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী হোসেন, মোশারফ হোসেন সাকিল, মো. শফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ নূর উদ্দিন ও মোহাম্মদ সালেহ আহমেদ।
আরও পড়ুন: ২০১০ সালে এমভি জাহান মনি ছিনতাই: ১০০ দিন পর ৪ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার
৪৫ হাজার ৬৫৩ ডেডওয়েট টন (ডিডব্লিউটি) ওজনের বাল্ক ক্যারিয়ার এমভি আবদুল্লাহর মোট দৈর্ঘ্য (এলওএ) ১৮৫ দশমিক ৭৪ মিটার এবং প্রস্থ ৩০ দশমিক ৪ মিটার। ২০১৬ সালে নির্মাণের পর এটির নাম ছিল 'গোল্ডেন হক'। গত বছর এসআর শিপিংয়ের বহরে যোগ দেওয়ার পর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'এমভি আবদুল্লাহ'।
বর্তমানে বাংলাদেশের ৯৬টি পতাকাবাহী জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে এসআর শিপিং ২৩টি সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনা করে। এসব জাহাজের বেশিরভাগ বাল্ক ক্যারিয়ার যেগুলো বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে পণ্য পরিবহন করে।
আগের ঘটনা: একই কোম্পানি, একই জলদস্যু
২০১০ সালেও একই শিপিং কোম্পানির মালিকানাধীন এমভি জাহান মণি সোমালি জলদস্যুদের ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিল।
জাহাজটি ৪৩ হাজার মেট্রিক টন আকরিক নিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে গ্রিস যাচ্ছিল। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এটি। ওইসময় জাহাজে ২৫ ক্রু এবং ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ মোট ২৬ ব্যক্তি ছিলেন। ১০০ দিন জিম্মি থাকার পর তাদের বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছিল জলদস্যুরা।
জাহাজ মালিকসহ বিভিন্ন সংগঠন নাবিকদের মুক্তির জন্য প্রচেষ্টা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে। জলদস্যুরা আটক নাবিকদের পরিবারের কাছ থেকে ১০৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
মুক্তিপণের টাকা পরিশোধের পর নাবিকেরা ওমানের সালালাহ বন্দর থেকে বিমানযোগে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।
উদ্ধার পদ্ধতি
এমভি জাহান মণি উদ্ধার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকা কর্মকর্তারা বলেন, ছিনতাইয়ের সঙ্গে কারা জড়িত এবং তারা কী চায় তা জানতে জাহাজ ছিনতাই হওয়ার পর আরও এক সপ্তাহ সময় লাগে।
কারণ ছিনতাইয়ের পর জলদস্যুরা জাহাজের মালিক সংস্থার খোঁজ করে একটি প্রোফাইল তৈরি করে। তাদের মুক্তিপণের পরিমাণ কোম্পানির প্রোফাইলের ওপর নির্ভর করে।
কোম্পানি যত ছোট, মুক্তিপণের দাবি তত কম আর কোম্পানি যত বড়, মুক্তিপণের দাবি তত বেশি হয়।
তাদের দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণ পেলে সাধারণত জলদস্যুরা জাহাজে থাকা নাবিকদের কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু তাদের যোগাযোগ শুরুর পর মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করতে কমপক্ষে তিনমাস সময় প্রয়োজন হয়।
এসআর শিপিংয়ের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার জাহান রাহাত টিবিএসকে বলেন, ''আমরা আশা করছি এক সপ্তাহের মধ্যে অপহরণকারীরা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। যোগাযোগ প্রক্রিয়া শুরু হলে জাহাজে থাকা ২৩ নাবিককে উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে কেএসআরএম।'